বর্তমান পৃথিবীতে সুন্দর করে কথা বলতে পারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা গুলোর মধ্যে একটি। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রেই যার গুরুত্ব অপরিসীম।
কথোপকথন বা পাবলিক স্পিকিং গুরুত্বপূর্ণ কারণ – বিতর্ক, বক্তৃতা, প্রেজেন্টেশন, জব ইন্টারভিউ, প্রফেশনাল কাজ, কর্পোরেট দুনিয়া অর্থাৎ সব গুলো ক্ষেত্রে ভালো করার অলিখিত সংবিধানের প্রথম নিয়ম সুন্দর করে কথা বলতে পারা।
তাই আপনি যদি নিজেকে আরো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে চান, তবে নিজের দক্ষতা গুলো উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। যা শুরু করা যায় নিজের কথা বলার দক্ষতা ঝালাই করার মাধ্যমে। তো চলুন জেনে নেয়া যাক সুন্দর করে কথা বলার কিছু উপায় –
৩. দৃষ্টি সংযোগ বা আই কন্টাক্ট
আপনি যদি সুন্দর করে কথা বলা শিখতে চান, তবে ধারাবাহিকভাবে এই উপায়গুলো অনুসরণ করতে পারেন। যা আপনার ব্যক্তি ও পেশাদার জীবনের সব ক্ষেত্রেই অবদান রাখতে সক্ষম।
১. সঠিক উচ্চারণ
সুন্দর ও সঠিক উচ্চারণ ভালো কথা বলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই জন্যই, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা বা বিতর্ক প্রতিটি ক্ষেত্রে উচ্চারণের ওপর বিশেষ নম্বর থাকে।
শুদ্ধ উচ্চারণ করার প্রথম শর্ত হচ্ছে এই বিষয়ে অবগত হওয়া যে আপনার কোন কোন উচ্চারণ ভুল হচ্ছে। আমাদের অধিকাংশেরই বিভিন্ন ক্রিয়া পদ গুলোতে ভুল হয়। যেমন– অনেকে ‘আমি কাজটি করেছি‘ না বলে, ‘আমি কাজটি করছি‘ বলে, তার জন্য পুরো বাক্যটি সৌন্দর্য হারায়।
সঠিক উচ্চারণ শেখার জন্য উচ্চারণের বিভিন্ন বই পড়তে পারেন। পাশাপাশি ইন্টারনেটে অসংখ্য ভিডিও ও ট্রান্সক্রিপ্ট রয়েছে এই বিষয়ে। দুই-একটি নিয়ম শিখে, ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারলে তা আপনার কথা বলার ধরনকে পাল্টে দিতে পারে।
২. আত্মবিশ্বাসী হওয়া
যেকোন মানবিক অনুভূতিই খুব সংক্রামক। কোন একজনকে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত দেখলে, তার জন্য নিজের অজান্তে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি হয়। ঠিক তেমনি আত্মবিশ্বাসও খুবই সংক্রামক, যা দ্রুত একজন থেকে আরেকজনের কাছে ছড়িয়ে পরে।
আপনি নিজে কনফিডেন্ট ও হাসিখুশি থাকলে, আপনার সামনের মানুষগুলোর মাঝে তা ছড়িয়ে পরবে। অন্যদিকে আপনি নিজেই যদি নিজের উপর বিশ্বাস করতে না পারেন যে, আপনি সুন্দর করে কথা বলতে পারবেন তবে তা অন্যকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হবে।
৩. দৃষ্টি সংযোগ বা আই কন্টাক্ট
কারো সাথে কথা বলার সময় তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজনের চোখের দিকে তাকালে, তার মনের অবস্থা অনেকটা বোঝা যায়। পাশাপাশি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে একজন মানুষের সাথে আরেকজনের গভীর সম্পৃক্তি তৈরি হওয়া সম্ভব।
আপনি যদি নির্দিষ্ট একজনের সাথে কথা বলেন, তাহলে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। যাতে এটা কখনো মনে না হয় যে, আপনি সামনের মানুষটিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
আর যদি কোন মঞ্চে উপস্থাপনা বা বড় সমাগমে বক্তৃতা করেন, তখন একটানা নির্দিষ্ট কারো দিকে না তাকিয়ে বরং আলাদা আলাদা করে একেকবার সমাগমের একেক অংশের দিকে তাকিয়ে সবার মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করুন।
এক্ষেত্রে ছোট্ট একটা টিপস দিয়ে রাখি, আপনি যদি কারো চোখের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করেন তাহলে আপনি সরাসরি তার চোখের দিকে না তাকিয়ে বরং কপালের মাঝ বরাবর, দুই ভুরুর মাঝখানের অংশটিতে তাকাতে পারেন। এতে করে সামনের ব্যক্তির মনে হবে যে আপনি তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন।
৪. শারীরিক অঙ্গভঙ্গি
আপনি কথা বলা শুরু করার আগেই মনের অজান্তে যে অংশটির মাধ্যমে আপনার ভাব প্রকাশ করেন তা হলো আপনার শারীরিক অঙ্গভঙ্গি। কথা বলার সময় বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে, অন্যদিকে তাকিয়ে, মাথা চুলকাতে চুলকাতে কথা বললে – সামনের মানুষটি আপনার সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা করবে না এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের সবারই ছোটখাটো কোন না কোন মুদ্রা দোষ থাকতে পারে। অনেক সময় আমরা সেগুলো সম্পর্কে নিজেরা অবগত থাকি না। অন্য কেউ ধরিয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত তা আমাদের মনের অগচরেই থেকে যায়। এক্ষেত্রে কেউ নিজে থেকে এ বিষয়ে মতামত দিলে আগেই প্রতিরক্ষামূলক আচরণ না করে বরং তার দৃষ্টিকোন থেকে তা বোঝার চেষ্টা করুন।
তাই নিজের সহজাত ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করতে, নিজে নিজের আচরণ পর্যবেক্ষণ করুন এবং সাথে সাথে আশেপাশের মানুষদের থেকে মতামত নিয়ে সেগুলো পরিহার করার চেষ্টা করুন।
৫. পোশাক পরিচ্ছদ
অনেকের কাছে পোষাক বা পরিচ্ছদকে কথা বলার উপায়ের অন্তর্ভুক্ত মনে না হলেও এই বিষয়টি অনেকটা শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মতোই কাজ করে। অর্থাৎ আপনি কথা বলা শুরু করার আগেই আপনার পোষাক-পরিচ্ছদ শ্রোতাদের আপনার সম্পর্কে কিছু ধারণা দিবে, যা তারা আপনার বক্তব্যকে কিভাবে গ্রহণ করবে তার অনেকটাই প্রভাবিত করে।
অঙ্গভঙ্গি আর পোষাকের মধ্য পার্থক্য হলো, অঙ্গভঙ্গি বা অভ্যাস পরিবর্তন অনেক সময় সাপেক্ষ একটি বিষয়। তবে পোশাক পরিচ্ছদ পরিবর্তন অনেক কম প্রচেষ্টায় আপনাকে অনেক ভালো ফলাফল দিতে পারে।
সাধারণত, বক্তব্য প্রদানের সময় জাঁকজমকপূর্ণ পোষাক এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। চেষ্টা করতে হবে যাতে কোনভাবেই শ্রোতার মনোযোগ আপনার বক্তব্য থেকে আপনার পোষাকের দিকে বেশী না যায়। এতে আপনার আপনার বক্তব্য যতোই গুনমান সম্পন্ন হোক না কেন তা শ্রোতার মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ হবে।
৬. জড়তা কাটিয়ে ওঠা
কথা বলার আগে আপনি যে জায়গায় কথা বলছেন বা যার সাথে কথা বলছেন, তার সাথে জড়তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। বক্তৃতার জন্য নির্দিষ্ট স্থান বা মঞ্চ নির্ধারিত থাকলে, বক্তৃতার আগে সেখানে হাঁটা-চলা করে দেখতে পারেন। এতে জড়তা অনেকটা কমে যায়।
সরাসরি কথোপকথনের ক্ষেত্রে প্রথমেই দুশ্চিন্তা গুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন, ঠিকমতো শ্বাস–প্রশ্বাস নিন, একটু হাঁটাচলা করুন, নিজের বসার বা দাঁড়ানোর স্থান পরিবর্তন করতে পারেন। এগুলো খুবই কার্যকরী পদ্ধতি।
সবার ক্ষেত্রেই যে এই পদ্ধতিগুলো সবসময় একইভাবে কাজে দিবে তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে নিজেই নিজের জন্য কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেন, যা অনেক সময় মঞ্চ অভিনেতা বা বড় বড় পাবলিক স্পিকাররা করে থাকেন। তারা নিজেরা নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজকর্ম তৈরি করে নেন যা তাদের মঞ্চে যাবার আগে জড়তা ও স্নায়ুর চাপ কমাতে সাহায্য করে।
৭.তাড়াহুড়া না করা
কথা বলার সময় আমরা অনেকেই খুব দ্রুত বা তাড়াতাড়ি কথা বলি। যার ফলে, পর্যায় ক্রমে একটার পর একটা বিষয় নিয়ে ঠিকমতো বলা হয় না। মনে রাখতে হবে, আপনার বক্তৃতা উপস্থাপন করা উচিত যারা আপনাকে শুনছেন, তাদের কথা মাথায় রেখে। তাড়াহুড়ো করে বলতে গিয়ে, যা বলতে চাই যদি তাই বল না হয়, তাহলে দ্রুত বলে লাভ কী?
সুন্দর করে কথা বলার জন্য বা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র সুন্দর পরিকল্পনা না করায় অনেক ভালো ভালো বক্তার কথোপকথন অনেক সময় অসংলগ্ন হয়ে যায়।
নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য সঠিক ও সুন্দর করে কথা বলতে পারা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রথম দিকে এই উপায়গুলো অনুসরণ করতে সংকোচ বোধ হলেও, একবার সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে পরবর্তীতে এর সুফল উপভোগ করা সম্ভব। সবগুলো উপায় একবারে প্রয়োগ করতে না চাইলে, দুই-একটি দিয়ে শুরু করতে পারেন।
সবকিছুর মূলে রয়েছে আপনার আগ্রহ ও সদিচ্ছা। শুধুমাত্র ক্রমাগত প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে–ই আপনি সুন্দর করে কথা বলতে পারার গুণটি অর্জন করতে পারেন।
ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স অনলাইন কোর্স!
বর্তমান দশকে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দশটি দক্ষতার একটি হলো ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। বহুব্রীহির সংক্ষিপ্ত এই অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দক্ষতাগুলো সম্পর্কে জানুন, ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সেগুলো প্রয়োগ করতে চেষ্টা করুন এবং নিজের ও আশেপাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করুন!

- সুন্দর করে কথা বলার ৭টি উপায় - March 23, 2021