সিভি লেখায় ভুলের মাশুল দিচ্ছেন না তো?

সামিরা আর ফারিহা দুই বান্ধবী। দক্ষতা এবং যোগ্যতায় দুইজন সমান পর্যায়ের হলেও, সামিরা একটা কাজ করতে গেলে অনেক সময় নিয়ে ও অনেক কিছু ঘেঁটে জিনিসটা সঠিকভাবে করার চেষ্টা করে। অপরদিকে, ফারিহা মানুষের কথায় খুব বেশি প্রভাবিত হয়।

বিপদ ঘটল তখন, যখন দুজনই চাকরির জন্য আবেদন করা শুরু করলো। সামিরার সিভি খুব সংক্ষেপ, এরপরেও তার বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক আসছে। আর অন্যদিকে ফারিহা তার সিভিতে সব অভিজ্ঞতা ও স্কিল দেয়ার পরও সে তেমন সাড়া পাচ্ছে না।

একজন চাকরি প্রত্যাশী হিসেবে ফারিহার মতো আপনিও হয়তো সিভি লিখে তা কাটছাঁট করতে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করেছেন। আপনি নিশ্চিত যে আপনার সিভিতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে: সিভিটি এক পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ; একটি স্পষ্ট অবজেক্টিভ (objective) রয়েছে; এবং সিভিতে সফট স্কিলের আধিক্য বিরাজমান।

তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলি জনপ্রিয় হলেও একটি আদর্শ সিভির জন্য জরুরি নয়। সিভি তৈরির বেলায় এরকম অনেক ধারণাই লোকমুখে শোনা যায় যা শুধুমাত্রই প্রচলিত, আবশ্যক নয়। এরকম প্রচলিত ও জনপ্রিয় কিছু সিভির ভুল ধারণা নিয়েই আমরা এই আর্টিক্যালে আলোচনা করব।

সিভি নিয়ে জনপ্রিয় কিছু ভুল ধারণা

সিভিতে ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ থাকা বাধ্যতামূলক

সিভির ভুল নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ এর কথা। আমাদের প্রায় সবার সিভি শুরু হয় যে বিষয়টি দিয়ে, তা হচ্ছে “ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ”। দুঃখজনকভাবে সিভির শুরুতেই দেয়া এই সেগমেন্টটা, আপনি শর্টলিস্টেড হবেন কিনা তাতে খুব একটা প্রভাব ফেলে না কারণ নিয়োগকর্তারা আপনার অভিজ্ঞতা এবং যোগ্যতা জানতে বেশি আগ্রহী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়সল্পতার কারণে নিয়োগকর্তা ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ একেবারেই এড়িয়ে যান।

তবে আপনি যদি সিভিতে ক্যারিয়ার অবজেক্টিভ রাখতেই চান সেক্ষেত্রে “I want to work as a content writer to…” এর বদলে, “Working as a content writer to…” এভাবে লিখলে তা দৃষ্টিনন্দন হয়। সিভিতে সবকিছুই এভাবে পরোক্ষভাবে লেখা শ্রেয়। সিভির উদ্দেশ্য আপনাকে বর্ণনা করা। সিভির মাধ্যমে আপনি সরাসরি নিয়োগকর্তার সাথে কথা বলছেন না, তার জন্য রয়েছে কভার লেটার।

“One-page rule” বনাম সিভি যত বড় তত ভাল

সিভির দৈর্ঘ্য কতো হতে পারে তা নিয়ে দু’ধরনের মতামত পাওয়া যায়। কেউ কেউ One-page rule”- এ বিশ্বাসী অর্থাৎ সিভি সবসময় এক পৃষ্ঠাই হতে হবে। আবার অনেকে মনে করেন, সিভিতে সকল প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে তা যদি বড় করতেও হয় তবে তা করাই শ্রেয়। দুইটি মতামতের একটিকেও পুরোপুরি সঠিক বলা যাবে না।

যদিও সিভির কোনো আদর্শ দৈর্ঘ্য নেই, তবে তা দুইপৃষ্ঠার মাঝে রাখা গেলে সর্বোত্তম। সিভিতে সবসময় পর্যাপ্ত তথ্য দিতে হবে তা ঠিক। নতুন গ্র‍্যাজুয়েটদের ক্ষেত্রে সিভি এক পৃষ্ঠায় নিয়ে আসা সহজ হলেও, যিনি বহু বছর ধরে কর্মরত আছেন তার ক্ষেত্রে এমনটা আশা করা বোকামি।

সকল চাকরির অভিজ্ঞতা ও এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস সিভিতে দেখাতে হবে

সিভির ভুল গুলোর মধ্যে অন্যতম একটা হচ্ছে, অনেকে মনে করেন, সিভিতে যত তথ্য দেয়া যায় তত ভাল। বিষয়টা আসলে তেমন না। ১০ বছর আগে আপনি কোথাও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করলে সেটা বর্তমানে আপনার সম্ভাব্য চাকরিদাতার সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব ফেলবে না, যদি না তা একান্তই বর্তমান কাজের সাথে প্রাসঙ্গিক হয়। অতিরিক্ত তথ্য দিলে নিয়োগকর্তা যেমন বিরক্ত হয়, তেমনি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়োগকর্তার চোখ এড়িয়ে যায়।

পূর্ব কর্মক্ষেত্রের বর্ণনা দেয়া বাঞ্ছনীয়

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়োগকর্তা আপনার পূর্ব কর্মক্ষেত্র নিয়ে খুব বেশী আগ্রহী নয়। কারণ তাদের কাছে কর্মক্ষেত্রের বর্ণনার চেয়ে জরুরী হল সেখানে পদ অনুযায়ী আপনি কী অবদান রেখেছেন এবং তা থেকে সংগঠন কী সুফল পেয়েছে। তাই অপ্রয়োজনীয় তথ্য না দিয়ে বরং সংক্ষেপে বুলেট পয়েন্টের মাধ্যমে নিজের অবদান ও অর্জনগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করুন।

এক্ষেত্রে, আপনার চাকরি জীবন ক্রমানুযায়ী (বর্তমানে যেখানে আছেন তা সবার আগে এরপরে বাকিগুলো উল্টো থেকে পর্যায়ক্রমে) উল্লেখ করলে তা আরো বেশী গ্রহণযোগ্য হবে।

সিভি হতে হবে সাদাকালো

অনেকেই মনে করেন সিভি রঙ্গিন করলে তা পেশাদারিত্ব হারায়। একটা সময় সাদাকালো সিভির প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে এই ধারণার পরিবর্তন আসছে। তবে সেক্ষেত্রে কালার সেন্সের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। অর্থাৎ, আপনাকে বুঝতে হবে কোন রংটা কোথায় মানানসই। সাধারণত খুব বেশি চিত্তাকর্ষক রং ব্যবহার না করে বরং হালকা ও চোখের জন্য আরামদায়ক রং ব্যবহার করাই শ্রেয়। মনে রাখতে হবে, পড়ার সুবিধার্থে নিয়োগকর্তা অনেক সময় সিভি প্রিন্ট করে নেয়। তাই রং ব্যবহার করলেও তা সাদা-কালো প্রিন্ট করলে কেমন দেখা যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

মনে রাখবেন আপনার সিভি আপনাকে প্রতিনিধিত্ব করে, তাই তা হতে হবে আপনার পার্সোনাল ব্র্যান্ডের অংশ। আপনি আপনার পার্সোনাল ব্র্যান্ড যেভাবে সাজাতে চান, সিভিতেও তার প্রতিফলন থাকতে হবে।

সফট স্কিল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে

সফট স্কিল আপনার সিভিকে আলাদা করে তুলে ধরতে ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে অনেকেই সিভিতেই গড়পড়তা কিছু সফট স্কিল লিখে রাখে যার বেশিরভাগই অন্যের মুখে শোনা কিংবা অন্য কারো সিভি থেকে নেয়া।

সত্য বলতে, নিয়োগকর্তাদেরও এসব গতানুগতিক সফট স্কিল পড়তে পড়তে মুখস্ত হয়ে গেছে। তাই সফট স্কিলের জায়গায় গতানুগতিক শব্দগুলো ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন যেমন; কুইক লার্নার কিংবা টিমওয়ার্কার ইত্যাদি। এর বাইরে যদি আপনার কোনো সফট স্কিল থেকে থাকে যা আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করতে পারে বলে মনে করেন, তবে তা উল্লেখ করতে পারেন। মূলত আপনার কাজের বিবরণ এবং অর্জনই আপনার সফট স্কিল নিয়ে ধারণা দিবে।

পিডিএফ (PDF) বনাম ডক (.doc) ফাইল টাইপ

সিভিতে পিডিএফ (PDF) বনাম ডক (.doc) ফাইল টাইপ
Image Credit: ResumeLab

সিভির ফাইল টাইপের ক্ষেত্রে অনেকেই পিডিএফকে প্রাধান্য দেয় আবার অনেকেই মনে করে ওয়ার্ড ফাইলে সিভি দেয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। এক্ষেত্রে যদি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে সিভির ফাইল টাইপ উল্লেখ করা থাকে তবে অবশ্যই সে অনুযায়ী দেয়া উচিত। তবে আপত্তি ঘটে তখন যখন বিজ্ঞপ্তিতে এধরনের কিছু উল্লেখ থাকে না।

অনলাইনে চাকরির আবেদন করার ক্ষেত্রে, ওয়ার্ড ফাইল যে কোনো অপারেটিং সিস্টেমে খোলা ও পড়া সহজ। আর চাকরিদাতা যদি অ্যাপ্লিকেন্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম (Applicant Tracking System – ATS) বা কিওয়ার্ড স্ক্যানিং সফটওয়্যার (Keyword Scanning Software) ব্যবহার করে, যা শত শত চাকরির আবেদন সয়ংক্রিয়ভাবে বাছাই করার জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে ডক ফাইল হবে সেরা মাধ্যম। কেননা প্রায় সব ধরনের অ্যাপ্লিকেন্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম বা কিওয়ার্ড স্ক্যানিং সফটওয়্যার ওয়ার্ড ফাইল পড়তে সক্ষম। যদিও বাংলাদেশে এর ব্যবহার তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

ওয়ার্ড ফাইল ব্যবহারের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, বহু হাত ঘুরে সিভি চাকরিদাতার কাছে পৌঁছালে তার ফরমেটিং ঠিক না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে পিডিএফ ফাইল টাইপ সফটওয়্যারের যেকোনো ভার্সনে বা যেকোনো রকম স্ক্রিনের সাইজের সাথে মানানসই হওয়ায় এর ফরম্যাটিংয়ে তেমন কোন পরিবর্তন হয় না।

রেফারেন্স দেয়া আবশ্যক

সিভি বানানোর সময় রেফারেন্স কাকে দিব এই নিয়ে অনেকেই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তবে সিভিতে রেফারেন্স বাধ্যতামূলক নয়। অনেক সময় চাকরি বিজ্ঞপ্তিতেই উল্লেখ থাকে রেফারেন্স দেয়ার কথা, সেক্ষেত্রে রেফারেন্স দেয়া উচিত। এর বাইরে যদি কোনো নিয়োগকর্তার রেফারেন্সের দরকার হয় তাহলে শর্টলিস্টিং-এর পরে তা চাওয়া হয়।

যদি ইতোমধ্যে রেফারেন্স ঠিক থাকে, তাহলে দিয়ে দিন। কিন্তু না থাকলে এই নিয়ে চিন্তা করার একদমই দরকার নেই। কিন্তু ভুলেও মিথ্যা রেফারেন্স দিবেন না, এতে পরবর্তীতে অনেক সমস্যায় পড়তে পারেন। রেফারেন্সের জায়গায় শুধু “Available upon asking” লিখে দিলেও তা গ্রহণযোগ্য হয়। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে চাকরির ফর্মেও রেফারেন্সের জায়গা থাকে। এক্ষেত্রে সেখানে উল্লেখ করলেও হবে।

সব রকম পদের জন্য একটি জেনারেল সিভি থাকা উচিত

২০২১ সালে বেশিরভাগ মানুষ শুধুমাত্র একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন না করে বরং একাধিক ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করে। তাই চাকরির আবেদনের বেলায় বিভিন্ন ধরনের চাকরির খোঁজ করা স্বাভাবিক। সুতরাং, সব জায়গায় জন্য একটা সিভি তৈরি করা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

তবে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় কয়েক ধরনের সিভি তৈরি করে রাখা যেতে পারে। যেমন ধরুন, আপনার ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও ভিডিও এডিটিং দুই ধরনের দক্ষতাই আছে। এখন আপনি ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে আবেদন করার সময় সিভিতে ডেভেলপমেন্ট-এর উপর জোর দিতে হবে আর ভিডিও এডিটরের সিভিতে আপনার ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার ও টুলে পারদর্শিতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

ধর্ম, লিঙ্গ, শখ ইত্যাদি উল্লেখ করা জরুরি

ধর্ম, লিঙ্গ, শখ ইত্যাদি বিষয়গুলো চাকরির আবেদনে তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাই এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে শুধু শুধু সিভির জায়গা নষ্ট না করাই ভালো। অনেক সময় পদ বিশেষে অনেক চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে কোনো বিশেষ লিঙ্গের মানুষকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়, সেক্ষেত্রে লিঙ্গ উল্লেখ করে দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে অবশ্য মানুষের নাম দেখেই লিঙ্গ এবং ধর্ম বোঝা যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে চাকরি প্রত্যাশী জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় যেকোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তিতেই অনেক আবেদন জমা হয়। সময় কম থাকায় হিউম্যান রিসোর্স এক্সিকিউটিভ খুব ধৈর্য সহকারে সবগুলো সিভি পড়তে পারেন না। তাই সিভি হতে হবে এমন যা খুব দ্রুত পড়ে এক নজরেই আবেদনকারী কেমন তা আন্দাজ করে ফেলা যায়। অর্থাৎ সিভিতে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় না রেখে শুধুমাত্র সে তথ্যগুলোই রাখা উচিত যা আপনাকে ঐ চাকরিটি পেতে সহায়তা করবে।

সিভি তৈরির সময় মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র একটা সিভির উপর ভিত্তি করে আপনার চাকরি হয়ে যাবে এমনটা নয়। কিন্তু উপরের বিষয়গুলো মনে রেখে নিজের সেরাটা দিয়ে সিভি তৈরি করতে পারলে আরো একশোটা সিভির মাঝে আপনার সিভিটাই নিয়োগকর্তার নজরে সবার আগে আসবে।

শেয়ার করুন

2 thoughts on “সিভি লেখায় ভুলের মাশুল দিচ্ছেন না তো?”

Leave a Comment