তোমরা যারা ইঞ্জিনিয়ারিং এডমিশন টেস্ট দিবে

ইন্টার পরীক্ষা শেষ করে অনেকেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করতে ঢাকাতে চলে এসেছো হয়তো। কেউ কেউ নিজের এলাকাতেই কোচিং করা শুরু করেছো। কোচিং করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তবে কোচিং এর সবথেকে বড় একটা লাভ আছে। রোজ এক্সাম দেওয়া যায়। অন্যদের সাথে নিজের পজিশনটা তুলনা করে নেওয়া যায়। কতটা এফোর্ট দিতে হবে আরো–এটা ভালো করে বোঝা যায় কোচিং করলে।

ইঞ্জিনিয়ারিং প্রিপারেশন নেওয়ার আগে একটা গল্প বলি। একটা লোক একদল ছাত্র নিয়ে একটা খেলা শুরু করলো। লোকটা একটা বলকে ভূমির সাথে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোনে ছত্রিশ মিটার পার সেকেন্ড বেগে ছুড়ে মেরে আনুভূমিক বরাবর ৬৬.২ মিটার দূরে পাঠিয়ে দিলো। ছাত্রদের বললো, নাও এবার তোমরা মারো। ৬৬ মিটার দূরে গেলেই তোমরা পাশ। প্রথম জন এসে গায়ের জোরসে মেরে দেখলো ৪০ মিটার দূরে গেছে বল। ঠোট উল্টায় ‘আমার দ্বারা সম্ভব না’ বলে ওই ছাত্রটা গেলো চলে। এরপরের ছাত্রটা বল পাঠালো ২৫ মিটার দূরে। কিন্তু এই ছাত্রটা ভাবলো, দেখি আরেকবার মেরে। এইবার মেরে বল গেলো ৩০ মিটার দূরে। মজা পেয়ে আবার মারলো বল। এবার আরো একটু দূরে গেলো। এইভাবে মারতে মারতে ছাত্রটা শেষমেশ বল পাঠালো ৬০ মিটার দূরে। শিক্ষক এসে দেখে শুনে বললো, তোমাদের স্টেজে এটাই আসলে তোমাদের ভিক্টোরির লেভেল।

কথা আলাদা কিছু না। সবাই যা বলে ওইটাই। তোমাকে এই কয়টা দিন খাটাখাটনি করে পড়তে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। আমি কেবল আমার কয়েকটা ব্যাপার শেয়ার করি।

আমি ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করতে ঢাকা এসেছিলাম। সেবারই ঢাকা প্রথম আসা। পথ ঘাটের কিছু চিনিনা। উদ্ভাস ফার্মগেট শাখায় ভর্তি হয়েছিলাম। ওইখানে ঢাকার অনেক স্টুডেন্ট। ঢাকার স্টুডেন্টরা আবার বেশি স্মার্ট। এদের চাল-চলন, পড়াশুনা দুইটাই স্মার্ট গোছের। ছোটখাট ব্যাসিক দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। আমরা যারা বাইরে থেকে এসেছি বিশেষ করে আমাদের একটু কমা কমা মনে হয় এদের কাছে। কাজেই হতাশার প্রথম মাত্রাটা এদের দেখে। এরা কই আর আমি কই?

উদ্ভাসে নিয়মিত একটা নেগেটিভ মার্কসহ ৭৫ মার্কের এমসিকিউ এক্সাম হয়। ২৫ মিনিটে ৩০টা কোশ্চেন সলভ করতে হবে। যার ম্যাস্কিমামই ম্যাথমেটিকাল। ফিজিক্স এক্সাম দিয়েছিলাম প্রথমটা। সেই লেভেলের কনফিডেন্স। ভেক্টোরে বস বস। প্রথম পরীক্ষা দিয়ে পেলাম ৭৫ এ সাড়ে আঠারো। এক নিমিষে কনফিডেন্স লেভেলের ১২টা বেজে গেলো। পরের সপ্তাহ গুলোতে ৭৫ এ এভারেজ মার্ক আসে ৩০ থেকে ৩৫। এই মার্ক আবার বাসায় যায়। দ্বিতীয় স্টেপের হতাশা বাসা থেকে অতিমাত্রার অসহ্যকর বকাঝকা শোনা।

এরপর প্রতি সপ্তাহে একটা করে উইকলি এক্সাম হতো। ১৫টা রিটেন কোশ্চেন সলভ করতে হয় ৪৫ মিনিটে। এই জিনিসটা প্রথমে দেখে মনে হয়েছিলো এ কোন অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন সলভ করতে আসলাম! এক একটা কোশ্চেন পড়ে বুঝতেই লাগে তিন মিনিট। কাজেই প্রথম এক্সামে মোটামুটি একটা বড়সড় ঝড় গেলো। ছয়টার মত সলভ করেছিলাম। সাথে এমসিকিউ ছিলো ৬০টা। তারপর আসলো একটা সেন্ট্রাল পজিশন। সারাদেশ থেকে একটা সেন্ট্রাল পজিশন করে দেয় উদ্ভাস। প্রথম এক্সামে পজিশন আসলো তিন হাজারের কাছাকাছি। এটুকু দেখেই হতাশ হয়ে যাওয়া যেতো। বুয়েটে টেকার কোন চান্সই নেই। কিন্তু আমার মনে পড়লো বল মেরে দূরে পাঠানোর প্রাসের গল্পটা। সেকেন্ড এক্সামটা দিতে পারিনি। ঢাকার পানি শরীর সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হয়ে গেছিলাম। উদ্ভাসে আবার প্রথম দুটো উইকলি এক্সামের রেজাল্ট দেখে তুখোড় ব্যাচে যায়গা দেয়। তুখোড়ে চান্স হয়নি। একটা জিনিস লোকেমুখে শোনা যায়, তুখড়ে চান্স না পেলে নাকি কোন ইঞ্জিনিয়ারিং-এই চান্স পাওয়া যায়না। ভুয়া কথা যতসব।

আমি প্রিপারেশন নিতে লাগলাম। উদ্ভাস থেকে কোশ্চেন ব্যাংক ধরিয়ে দিয়েছিলো অনেকগুলো। নিয়মিত ক্লাস করতে যেতাম। কারন একটাই উদ্ভাসে বুয়েটের বস বস ভাইয়ারা ক্লাস নিতো। এক একটা ক্লাস করার পর বুঝতাম কত হালকা পাতলা ব্যাসিক নিয়ে ইন্টার পার করে আসছি। ক্লাসের উপর সেই লেভেলের ডেডিকেটেড ছিলাম। আমি ভর্তি হয়েছিলাম ফার্মগেট কিন্তু বাসা নিয়েছিলাম মিরপুর। ওখান থেকে প্রতিদিন ঝুলে ঝুলে বাসে আসতে হতো। ফার্মগেট থেকে মিরপুরে বাস পাওয়া যেতোনা সহজে। সব মিলিয়ে দিনের দেড় দুই ঘন্টা যেতো শুধুমাত্র যাতায়াতে। তারপর বাস জার্নি করে রুমে গিয়ে আসতো সেই মাত্রার একটা ঘুম।

ভাইয়ারা সবসময় বলতো, “বেশি বেশি কোশ্চেন ব্যাংক সলভ করবা।” এর গুরুত্বটা কয়দিন পর টের পেলাম। এডমিশনের পুরো ব্যাপারটাই আসলে টাইমিং। তুমি সবগুলা কোশ্চেন সলভ করতে পারো, এটা কোন ক্রেডিবল ব্যাপার না। তুমি একটা অল্প সময়ের মাঝে চাপ মাথায় নিয়ে কতগুলো কোশ্চেন সলভ করতে পারলে এটাই আসল কথা। কাজেই এডমিশন প্রিপারেশনের পুরো ব্যাপারটাই হলো তোমার মাথা কত ফাস্ট করতে পারো। এইজন্য অবশ্যই প্রতিটা টপিকসে তোমার ব্যাসিক লেভেলের নজেলটা অনেক বেশি শক্ত হতে হবে।

বেশি কোশ্চেন সলভ করার ফলাফলটা কয়দিন টের পেলাম। আগে ৪৫ মিনিটে পারতাম ছয়টা কোশ্চেন সলভ করতে। এখন পারছি আটটা। ডেইলি এমসিকিউ এক্সামের রেজাল্ট ত্রিশের ঘর থেকে চল্লিশের ঘরে উঠে এসেছে। চার পাঁচটা উইকলি এক্সাম দেওয়ার পর দেখলাম পজিশনটা চলে এসেছে দুই হাজারের নিচে। এরপর কনফিডেন্স লেভেলটা ভালোই বেড়ে গেলো। বুঝলাম যত বেশি কোশ্চেন সলভ করছি ব্রেইন তত বেশি ফাস্ট হচ্ছে। সলভিং না পারলে সল্যুশন দেখছি। সলুশন প্রসেস দেখে অবাক হচ্ছি। একটা ম্যাথ কতভাবে চিন্তা করা যায়! কত সোজা উপায়ে ভাবা যায়! এভাবে করে ব্রেইন ট্রেনিং হচ্ছে।

আমি আগাগোড়া এভারেজ মানের স্টুডেন্ট ছিলাম। বুয়েটে চান্স হবে এটা আমি রেজাল্ট পাওয়ার আগ পর্যন্তও ভাবিনি। কিন্তু সামহাউ হয়ে গেছে। আল্লাহ সহায় ছিলেন। আমি লেগে থাকার সাহস আর শক্তিটুকু ওই সময়ে আমার ভিতর খুব সুন্দর করে লালন করতে পেরেছিলাম। তা না হলে হয়তো আজকের এই যায়গায় আসতে পারতাম না।

তোমরা যারা ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করবা জাস্ট কয়টা জিনিস মাথায় রাখার চেষ্টা করো। প্রথম কথা হলো, ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য ব্যাসিকটা সবথেকে ভালো রাখতে হয়। ব্যাসিক একটু দুর্বল হলে সমস্যা নেই। এই কটা মাসে ব্যাসিক শক্ত করার জন্য এনাফ টাইম পাবে। তার জন্য ডেডিকেটেড মানের স্টুডেন্ট হতে হবে।


আরও পড়ঃ বুয়েট ভর্তি প্রস্তুতি- সহায়ক টিপস

প্রচুর হতাশ হবে, ফ্রাস্টেটেড হবে। বাসাবাড়ি থেকে সাপোর্ট এর যায়গা ঝাড়ি টাড়ি খাবে প্রচুর। ডেইলি এক্সামে ৭৫ এ ২৭ – ২৮ পেলে খাওয়ারই কথা। এই নিয়ে হতাশ হলে চলবেনা। রিলেশন যারা করো, এই সময়ে কেন জানি রিলেশনশিপটায় খুব বাজে টাইম যাবে। টাইম কিংবা এটেনশন কোনটাই দিতে পারবে না ভালো করে। বাজে রেজাল্ট করে পড়াশুনা নিয়ে হতাশ হয়ে এমনিতেই মেজাজ খারাপ থাকবে। কাজেই রিলেশনে রুড বিহ্যাভ করে বসবা মাথা গরম করে। এই ব্যাপারগুলো একটু কৌশলে কথা বলে হ্যান্ডেল করতে হবে।

ঢাকায় যারা এসেছো। অনেকেই বন্ধু বান্ধবের সাথে থাকবে। পড়ার থেকে আড্ডাই বেশি হবে। আমি অনেক সার্কেলকে দেখেছি, ভালো স্টুডেন্ট কিন্তু এই আড্ডাবাজি পরিবেশের জন্য পড়াশুনার বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে। ড্রিমের প্রতি ফ্যাসিনেশন থাকলে অবশ্যই নিজের ভালোটা বুঝার সেন্স রেখো। ‘একটু আড্ডা দিলে কিছু হবেনা’ মেন্টালিটি ঝেড়ে ফেলানোটাই বেটার। লেগে থাকার মেন্টালিটি ধরে রাখলেই হবে। আর কিছু লাগবেনা।

যে কয়টা দিন পাবা পড়াশুনা করে কাজে লাগাও। তুমি বস লেভেলের স্টুডেন্ট হলে আলাদা কথা। তেমন কিছু বলার নেই। আর একটা কথা, পড়াশুনা করতে বসলে কেন জানি স্মার্টফোন, ফেসবুক, গেমস এগুলা খুব টেনে ধরে। ভালো হয় স্মার্টফোনটা স্যুটকেসের ভিতর রেখে একটা নোকিয়া ১২০০ মডেলের ফোন ইউজ করলে।

সবার জন্য শুভ কামনা। দিনশেষে তোমাদের পরিশ্রমটুকু সফলতা অর্জন করুক সেই কামনা করি।

শেয়ার করুন

1 thought on “তোমরা যারা ইঞ্জিনিয়ারিং এডমিশন টেস্ট দিবে”

Leave a Comment