You are currently viewing হেডি লামার- প্যাটেন্ট এবং প্রতারিত হবার গল্প

হেডি লামার- প্যাটেন্ট এবং প্রতারিত হবার গল্প

অভিনয়ের জগৎটাকে আমরা যেভাবে দেখি, বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক কঠিন। শুটিংএর দিনগুলোতে অভিনেতাদের ভোর ছয়টায় স্টুডিওতে হাজির হতে হয়, অভিনেত্রীদের আরও আগে – মেকআপে বেশি সময় লাগে বিধায়। প্রায় দিনই ভোর চারটা থেকে রাত পর্যন্ত কাজের শিডিউল। বাকি সময়টা ঘুমানোর চেয়ে অন্য কিছু করার সুযোগ কই?

হেডি লামারের জন্ম ১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়াতে, ইহুদি পরিবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে যখন জার্মানরা অস্ট্রিয়া দখল করে নেয় এবং ইহুদিদের উপর নির্যাতন শুরু করে, হেডি প্রথমে ইংল্যান্ডে এবং তারপর সেখান থেকে আমেরিকাতে পালিয়ে আসে। জাহাজে আসার পথে সে নজরে পড়ে এমজিএম স্টুডিওর কো-ফাউন্ডার লুইস মেয়ারের। আমেরিকার মাটিতে পা রাখার আগেই এমজিএমএর কন্ট্রাক্ট অভিনেত্রী হিসাবে চাকরি পেয়ে যায় সুন্দরী হেডি। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। আমেরিকার মুল ভূখণ্ড আক্রান্ত না হলেও যুদ্ধের আঁচ লাগতে শুরু করেছে মার্কিন জনজীবনে।

হেডি ল্যামার- বহুব্রীহি

আগেই বলেছি অভিনয়ের জীবন সহজ না, অবসর নাই বললেই চলে। সারাদিন কাজের পর রাতে বাসায় ফিরে এর ফাঁকেই হেডি কাজ করে চলেছে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে। আটলান্টিক মহাসাগরে জার্মান আধিপত্যের সাথে পেরে উঠছে না মিত্রশক্তি। জার্মান ইউবোটগুলোর দিকে তাক করা রেডিও কন্ট্রোলড টর্পেডোগুলোর সিগন্যাল জ্যাম করে সেগুলোকে অকেজো করে দিচ্ছে শক্তিশালী জার্মান নৌবাহিনী। হেডির মাথায় আইডিয়া এসেছে কিভাবে এই সিগন্যাল জ্যামিং বন্ধ করা যায়। সেটা নিয়েই বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা সে চালিয়ে যাচ্ছে রাতের পর রাত। তার আবিষ্কারটা সহজ ভাষায় এরকম – একই ফ্রিকুয়েন্সি দিয়ে পুরো সিগন্যাল না পাঠিয়ে, কোডেড সিগনালকে অনেকগুলো ভাগে ভেঙ্গে একেক অংশ একেক ফ্রিকুয়েন্সি দিয়ে পাঠালে জার্মানরা সেই সিগন্যাল জ্যাম করতে পারবে না। এটা আমি পাঠকের সুবিধার্থে সহজ ভাষায় বললাম, মুল আবিষ্কারটি আরও কঠিন। ১৯৪১ সালে হেডি এই আবিষ্কারটির প্যাটেন্ট এপ্লিকেশন জমা দেয় এবং ১৯৪২ সালে প্যাটেন্টটি গ্র্যান্টেড হয়। তখন তার বয়স মাত্র ২৮ বছর।

অভিনেত্রী হেডির পক্ষে আবিষ্কারটিকে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব না। হলিউড থেকে সে সোজা চলে আসলো ওয়াশিংটন ডিসিতে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ বিষয়ক কাউন্সিলের কাছে প্যাটেন্টটি পেশ করে বললো, তোমরা এটা দিয়ে সিগন্যাল জেনারেটর বানাও, জার্মানরা আর তোমাদের পাঠানো সিগন্যাল জ্যাম করতে পারবে না। আর আমাকে একটা চাকরি দাও, আমার মাথায় আরও আইডিয়া আছে, সেগুলো দেশের উপকারে আসবে।

পুরো কাউন্সিল অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। অভিনেত্রীর কাজ দর্শকদের মনোরঞ্জন করা, বিজ্ঞানের কচকচির মধ্যে না গেলেই ভালো হয়! তারা বললো, তুমি এক কাজ করো, এইসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদের জন্য টাকা তুলো। যুদ্ধের অনেক খরচ, সরকার বাহাদুর ওয়ার বন্ড ছেড়েছে বাজারে। তুমি দেখতে সুন্দরী আছো, তাছাড়া চলচিত্রের পর্দায় দেখে তোমাকে লোকজন চিনে। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে বন্ড বিক্রি করো। হেডি সেটাই মেনে নিলো। যে শহরেই সে যায়, সুন্দরী অভিনেত্রীকে দেখার জন্য লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ২৯০ মিলিয়ন ডলারের ওয়ার বন্ড সে একাই বিক্রি করেছিল। আর সেই প্যাটেন্ট? ঠাই পেলো কোন মাথামোটা জেনারেলের ড্রয়ারে, কেউ সেটা পড়ে দেখার দরকার বোধ করলো না।

যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। হেডি চিঠি লিখে জানতে চেলো তার প্যাটেন্টকে কি মার্কিন সেনাবাহিনী কাজে লাগাতে পেরেছে? তাকে কি উত্তর দেয়া হয়েছিলো শুনলে যে কেউ স্তম্ভিত হয়ে যাবে। উত্তরের সারমর্ম ছিল –

“তুমি অস্ট্রিয়ান নাগরিক, এখন অস্ট্রিয়া জার্মানির অধীনে। অতএব, তুমি শত্রু দেশের লোক। এতদ্বারা জানানো যাইতেছে যে, শত্রু সম্পত্তি হিসাবে তোমার আবিষ্কারটি মার্কিন সরকার বিনা স্বীকৃতিতে দখল করে নিয়েছে।”

হেডি আফসোস করে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলো, আমি বিদেশী মানুষ সারা আমেরিকা ঘুরে যুদ্ধের জন্য ২৯০ মিলিয়ন ডলার চাঁদা তুলে দিলাম, আর আজকে আমি হলাম শত্রু! পরবর্তীতে অবশ্য হেডি মার্কিন নাগরিক হয় এবং তার প্যাটেন্ট শত্রুসম্পত্তি তালিকা থেকে তুলে নেয়া হয়।

সরকারের কাছ থেকে জবাব পেয়ে হতভম্ভ হেডি তার বস এমজিএমএর বড়কর্তাকে বলল, আমার মাথায় কিছু আইডিয়া ছিল, অভিনয়ের পাশাপাশি আমি সেগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই। তাকে আশাহত করে বলা হলো, যুদ্ধ শেষে সৈনিক ভাইয়েরা ক্লান্ত হয়ে দেশে ফিরছে, তোমার এখন কর্তব্য তাদের মনোরঞ্জন উপযোগী চলচিত্রে অভিনয় করা। বিজ্ঞান তোমার বিষয় না, ওইসব বিজ্ঞানীদের হাতে ছেড়ে দাও। এমজিএমএর কাছে চুক্তিবদ্ধ বিধায় একের পর এক বি-গ্রেড চলচিত্রে অভিনয় করতে বাধ্য হলো হেডি।

অনেক বছর পর হেডি জানতে পারলো কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সময় মার্কিন বাহিনী ফ্রিকুয়েন্সি হপিং টেকনোলজি ব্যাবহার করেছে সিগন্যাল জ্যামিং ঠেকানোর জন্য। তখন সে আর্থিক কষ্টে ভুগছে। ফ্রিকুয়েন্সি হপিং তার আবিষ্কার, তাই এর থেকে কিছু সম্মানী তার প্রাপ্য। সরকারকে সে চিঠি লিখলো। সরকারের তরফ থেকে জানানো হলো আবিষ্কারের ২০ বছর পর যে কোন প্যাটেন্ট পাবলিক প্রপার্টি, অতএব এর উপর তোমার আর কোন স্বত্ব নাই! ফের খোঁজ নিয়ে হেডি জানলো সরকার ১৯৫৬ সাল থেকেই গোপনে এই আবিষ্কার ব্যবহার করছে, যখন তার প্যাটেন্টের মেয়াদ ছিল। সেই ব্যপারে আবেদন করতে তাকে আবারও চিঠি দিয়ে জানানো হলো, প্যাটেন্ট ভায়লেশনের ৬ বছরের মধ্যে কেইস করতে হয়, যেহেতু ৬ বছরের বেশি হয়ে গিয়েছে, আবারও দুঃখের সাথে জানানো যাচ্ছে তোমার এখন কিছুই করার নাই। কি অন্যায়! কি অবিচার!!!

হেডির আবিষ্কারকে ব্যবহার করে তৈরি বেশ কিছু টেকনোলজি আমরা দৈনন্দিন জীবনে আজ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি – WiFi, GPS, Bluetooth ইত্যাদি। ২০০০ সালে ৮৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে মারা যান হেডি লামার। তার ইচ্ছা অনুযায়ী তার দেহাবশেষের ছাই জন্মভূমি অস্ট্রিয়াতে ছিটিয়ে দেন তার পুত্র।

২০১৪ সালে হেডি লামারকে ইউ এস প্যাটেন্ট অফিস সর্বোচ্চ সম্মান ইনভেন্টর’স হল অফ ফেইমে মরণোত্তর স্থান দিয়ে নিজেদের পাপ মোচন করে! আর সেই প্যাটেন্ট, যেটা থেকে হেডি এক পয়সাও পান নাই, তার উপর ভিত্তি করে তৈরি আবিষ্কারগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!

Masud Karim Khan
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
most voted
newest oldest
Inline Feedbacks
View all comments
Nafis Sadiq
Nafis Sadiq
June 14, 2018 4:38 pm

অনেক কিছু জানতে পারলাম 🙂

mahedi hasan
mahedi hasan
April 3, 2019 3:30 pm

jana gelo onek kisu

Tahseen
Tahseen
March 22, 2019 2:28 pm

keep it up