চাকরির বাজারে সিজিপিএর গুরুত্ব কতটুকু?

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালসের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নওরিন বর্তমানে ইন্টার্নশিপ করছে হিউম্যান রিসোর্স টেকনোলজি বেসড কোম্পানি কালকে-তে। চাকরির বাজার নিয়ে ধারণা আর পূর্ব অভিজ্ঞতা কম থাকায় সমবয়সী আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো নাওরিনও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলেন – “সিজিপিএ না স্কিল?” এমনকি কালকে-তে আবেদন করার সময়ও নওরিন খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিলো না। কারণ তার ধারণা ছিলো, চাকরির বাজারে গড়পড়তা সিজিপিএ থেকে বেশি সিজিপিএ পাওয়া আবেদনকারীরা সবসময়ই অগ্রাধিকার পায়।

নওরিনের ধারণা কিছুটা হলেও বদলে যায় যখন সে স্কিল সেট নিয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে টিকে যায়। নওরিনের মতোই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে আমরা যে দোটানায় পড়ি, তা হলো চাকরির বাজারে সিজিপিএর গুরুত্ব নিয়ে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেটের প্রয়োজনীয়তা কেমন?

ইতোমধ্যে আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে, গুগলের মতো বড় কোম্পানিতে বহু পজিশনের ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক রেকর্ডের উপর তুলনামূলকভাবে কম জোর দেয়া হয়। প্রায় একই রকম চিত্র দেখা যায় অ্যাপল, অ্যামাজন, আইবিএমের মতো বড় বড় কোম্পানির ক্ষেত্রেও।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

আমাদের দেশে এখনো চাকরির বাজারে ডিগ্রি বা অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট আর রেজাল্টকে অনেকাংশেই প্রাধান্য দেয়া হয়। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে অন্তত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও ৩.৫০-এর উপরে সিজিপিএ রাখা প্রায় সময় আবশ্যক।

তরুণ প্রজন্মের কাছে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় জব সেক্টর হচ্ছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আর ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংক আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে সবসময় আবেদনের জন্য নূন্যতম সিজিপিএ ধরে দেয়া হয় না। তবে দেখা যায়, বেশি সিজিপিএসহ আবেদনকারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। আবার সরকারি ব্যাংকগুলোতে উল্লেখ থাকে ২.০০-এর উপর সিজিপিএ থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে সিভি জমা দেয়ার জন্য মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক এ তিনধাপের কোনো এক ধাপেও তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়।

কিন্তু ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বহু জায়গায় অনেকে প্রচার করেন যে, “সিজিপিএ ব্যাপার নয়।” তাহলে কোনটা সঠিক? 

পেশাদাররা কী মনে করেন?

বাংলালিংকের ট্রেড-মার্কেটিং ম্যানেজার পার্বণ আচার্য্যর কাছে এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সিজিপিএ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সিজিপিএ-ই একজন শিক্ষার্থীর প্রথম ইম্প্রেশন বহন করে। এর দ্বারা বোঝা যায়, একজন শিক্ষাজীবনে তার দায়িত্বের প্রতি কতটা আন্তরিক ছিলো। কাউকে নিয়োগ করার পর সে কতটুকু দায়িত্বশীল আর নিবেদিত হবে, সে ধারণাও নিয়োগকর্তা পান। এজন্য সিজিপিএ-কে কর্মক্ষমতার একটি মাপকাঠি হিসেবে গণনা করা হয়।

ব্যাপার হলো, সিজিপিএ কম হতেই পারে। কিন্তু তার পেছনে একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকা দরকার। চাকরি করতে দরকার হয় এমন স্কিল ডেভেলপমেন্টে যদি আপনি শিক্ষাজীবনে সময় দিয়ে থাকেন, তবে তা আপনার চাকরির আবেদনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

সিজিপিএ আর স্কিলের সামঞ্জস্য রাখা জরুরি। প্রায় সময় আমরা এর মাঝে যেকোনো একটার পেছনে অনেক সময় ব্যয় করে আরেকটাতে তেমন মনোযোগ দিতে পারি না। কিন্তু বর্তমানে ভালো চাকরি পাবার জন্য দুইটাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

একটা ন্যূনতম সিজিপিএ সবারই ধরে রাখা দরকার। কারণ নিয়োগকর্তারা বহু ক্ষেত্রে সিজিপিএর ভিত্তিতে সিভির শর্টলিস্ট করেন। একজন শিক্ষার্থীর নূন্যতম ৩.০০ ধরে রাখা উত্তম। নতুবা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সে সিভিই জমা দিতে পারবে না।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রিয় একটি কোম্পানির হিউম্যান রিসোর্স এক্সিকিউটিভকে এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন,  “গত এক বছরে আমি পুরো নিজ দায়িত্বে কমপক্ষে দশজন নতুন সদস্য নিয়োগ করেছি। এক্ষেত্রে আমি ৩.৪০ পাওয়া একজনকে বাদ দিয়ে ২.৯০ পাওয়া একজনকে নির্বাচন করেছি। আমি সিজিপিএ-এর ওয়েট অন্য আরো প্রয়োজনীয় ক্রাইটেরিয়া থেকে কম ধরেছি। কারণ ভালো ছাত্রের থেকেও আমার দরকার ছিলো এমন একজনকে যে আমার প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন করতে পারবে। ফলাফল? এ এক বছরে আমার নির্বাচিত ব্যাচকে নিয়ে কেউ কখনো কোনো নালিশ করতে পারেনি।

কিন্তু এখন যে প্রতিষ্ঠানে সিজিপিএকেই সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হয়, সেখানে এমনটা হবে না। সেখানে ২.৯০ থেকে অবশ্যই ৩.৪০ কে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। তাই সিজিপিএ একদম গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমনটাও না। ফ্রেশম্যান থাকতে আমরাও শুনতাম, সিজিপিএর কোনো ভ্যালু নেই। কিন্তু আমার মতে, ন্যূনতম একটা সিজিপিএ মেইনটেইন করলে নিরাপদে থাকা যায়।

সিজিপিএর গুরুত্ব আসলে নির্ভর করে পুরোপুরি নিয়োগকর্তার উপর।”

বাংলাদেশের লিডিং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একজন ফাইন্যান্স প্রফেশনাল বলেন, “জব সেক্টরে সিজিপিএ একমাত্র নয়, বরং অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। ৩.০০-এর নিচে সিজিপিএ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু তা উতরে উঠা সম্ভব। ৩.৫০-এর উপরে সিজিপিএ সিভিতে দেখতে অনেক ভালো দেখালেও তা চাকরির নিশ্চয়তা দেবে না। বিশেষ করে আপনি যদি ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনার প্রেজেন্টেশন, ইংরেজিতে দক্ষতা, লিডারশীপ ইত্যাদি স্কিল ফুটিয়ে তুলতে না পারেন।”

বাংলাদেশের একজন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তার (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সিজিপিএ অন্যদের তুলনায় অনেক কম থাকলেও ছাত্রজীবনে তিনি ভার্সিটির বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, “এক্সট্রাকারিকুলামে অনেক নিষ্ক্রিয় থাকা আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু যখন আমার আগে চাকরি পেয়ে যাচ্ছিলো, তখন অনেক হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।

কিন্তু মনে হলো, ৫টা প্রতিষ্ঠান যদি সিজিপিএকে বেশি মূল্যায়ন করে, তাহলে আরো ৫টা আছে, যেগুলো করে না। আমার কাজ হচ্ছে শুধু ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবেদন করা। আমার অনেক জুনিয়র আমার কাছে আসে কম সিজিপিএ নিয়ে কী করবে সে বিষয়ে পরামর্শ চাইতে। আমি তাদেরও একই কথা বলি।”

তাহলে কী করা উচিত?

সিজিপিএ না দক্ষতা চাকরির বাজারে কোনটি এগিয়ে
চাকরি পাওয়া বা না পাওয়া অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। চাকরির বাজারে উপর আপনার নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু চাকরির সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য আপনি কিছু কাজ করতে পারেন।

লক্ষ্য ঠিক করে ফেলুন

শুরুতেই নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করে নেয়া জরুরি। কেউ শিক্ষকতায় যেতে চাইলে তাকে লেখাপড়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আবার যদি কেউ এমন কোনো জব সেক্টরে যেতে চান যেখানে প্র্যাকটিক্যাল স্কিলের মূল্য বেশি, তাহলে স্কিল ডেভেলপমেন্টে মনোযোগ দিতে হবে। সাথে একটা ন্যূনতম সিজিপিএ ধরে রাখা দরকার।

সিজিপিএ কম থাকলে বহু প্রতিষ্ঠানে বা চাকরিতে আবেদন করা যাবে না। এ কথাটা মাথায় রেখে আগাতে হবে যাতে কোনো অপশন বন্ধ না হয়ে যায়।

অ্যাকাডেমিক জীবন থেকে স্কিল অর্জনে সময় দেবার চেষ্টা করুন

স্নাতকের চার বছরে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বা ছুটির সময় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা চালান। যেমন, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে যেকোনো পজিশনের ক্ষেত্রে মাইক্রোসফট এক্সেলে পারদর্শিতা চাওয়া হয়। তাই আগেভাগে এটি শিখে নিন।

ভালোভাবে ইংরেজি জানা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্কিল যেটি যেকোনো প্রতিষ্ঠানে কাজে দেয়। তাই চলনসই ইংরেজিতে লেখা ও বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন। ইংরেজির বাইরে অন্য ভিনদেশী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে অনেক প্রতিষ্ঠানে অগ্রাধিকার পাবেন। যেমন, বর্তমানে মান্দারিন ভাষায় দক্ষ ব্যক্তিরা দেশী-বিদেশী চাকরির বাজারে সুবিধা পেয়ে থাকেন। এছাড়া নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী জার্মান, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, পর্তুগিজ নানান ভাষা শিখতে পারবেন।

সিজিপিএর গুরুত্ব এখনো রয়েছে

অ্যাকাডেমিক রেজাল্টই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – এমন চিন্তাভাবনা থেকে আমাদের দেশের নিয়োগকর্তারা অনেকটা বের হয়ে এসেছেন। কিন্তু “CGPA doesn’t matter” আমাদের দেশের জন্য এখনো প্রযোজ্য নয়। তবে ভালো ব্যাপার হলো, বহু প্রতিষ্ঠানে দিনদিন অ্যাকাডেমিক রেজাল্টের চেয়ে স্কিলকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

তাই গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তা কমাতে হলে স্কিল আর রেজাল্টের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা উচিত। সিজিপিএ যাই হোক না কেন, চাকরির বাজারে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য আপনাকে লেখাপড়ার পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির দরকারি স্কিলগুলোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Comment