নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট থাকা জরুরী কেন?

যুদ্ধের ময়দানে আপনি যেমন ঢাল-তলোয়ার ছাড়া খালি হাতে শত্রুর বিপক্ষে লড়াই করতে যাবেন না, তেমনি প্রযুক্তির এই যুগে এসে নিজের ডিজিটাল প্রেজেন্স (Digital Presence) বা পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট ছাড়া চাকরির বাজারে প্রবেশ রীতিমত বোকামীর শামিল।

পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট তৈরি করা আপাত দৃষ্টিতে খুব জটিল ও ব্যয়বহুল মনে হলেও, বাস্তবে কিন্তু ততোটা কঠিন নয়। নিজের জন্য একটি পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট তৈরি করার পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারন রয়েছে।

“প্রচারেই প্রসার!” এই প্রবাদটি আমরা সবাই শুনেছি। একুশ শতকের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আপনাকে অবশ্যই বাকি ১০ জনের মাঝখানে নিজেকে ইউনিক বা আলাদা হিসেবে তুলে ধরতে হবে। আর তাই ডিজিটাল বাংলাদেশে বা গোটা বিশ্বে, পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট এখন অনেকটাই “must have” এ পরিণত হয়েছে। কারণ, 

বর্তমান বাজারে শুধু চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা অর্জন করলেই হবে না, বরং এর প্রচার করতে হবে। আর নিজের প্রচার ও প্রসারের জন্য ডিজিটাল মাধ্যম হিসেবে নিজের একটি পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট হচ্ছে অন্যতম সেরা উপায়।

কেন নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট তৈরি করবেন?

আগেই বলেছি, পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট তৈরি করার পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারন রয়েছে। এখানে কিছু বিশেষ কারন তুলে ধরা হলোঃ

নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে নতুন যুগের আধুনিক রেজুমে তৈরি করুন:

ধরে নেয়া যাক আপনি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বিগত পাঁচ বছর যাবত একজন ডিজিটাল মার্কেটার হিসেবে কাজ করছেন। আপনি এমন একটি পদে রয়েছেন, যেখানে আপনার সেরা টা দিয়ে আপনি কাজ করছেন। ইতোমধ্যেই আপনি কোম্পানির হয়ে বেশ কিছু সাফল্য এনে দিয়েছেন। 

একসময় যেমন নিজের সিভি বা রেজুমে আপডেটেড রাখতে বলা হতো, তেমনি এখন নিজের পোর্টফোলিও আপডেটেড রাখতে বলা হয়ে থাকে। তাই, উক্ত কম্পানির হয়ে আপনি যেসকল সাফল্য এনে দিয়েছেন সেগুলো তুলে ধরুন। যদি দলগতভাবে কোনো কাজ করে থাকেন তাহলে দলে আপনার অবদানের কথা তুলে ধরুন। এতে করে পরবর্তী কর্মক্ষেত্রে আপনার পদবী ও অবস্থান দুটোই বৃদ্ধি করে দিবে। 

দিনে, সপ্তাহে কিংবা মাসে খুব অল্প কিছু সময় এই ওয়েবসাইটের পেছনে ব্যয় করলে যেসকল সুবিধা আপনাকে এনে দিবে তা অমূল্য। পরবর্তীতে যখন নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি খুঁজতে যাবেন তখন এই পোর্টফোলিও ওয়েবসাইটটি হবে আপনার রেজুমি। আর এই রেজুমি সেই পুরনো দিনের কাগজে ছাপানো নয় বলে আপনি বাকি চাকরি প্রার্থীদের থেকে ১ ধাপ এগিয়ে রইলেন।

ক্যারিয়ার প্রোগ্রেস ও শেখার আগ্রহকে তুলে ধরুন:

নতুন যেকোনো কিছু শেখা অনেক সময় দূরহ মনে হতে পারে। তবে সব কিছুই সহজ মনে হয় যদি একটি সঠিক গাইডলাইন বা সঠিক অ্যাপ্রোচ ফলো করে আগানো যায়। যেকোনো কিছু শেখার কৌশল নিয়ে আমাদের বিস্তারিত আর্টিকেল “কীভাবে যে কোনো কিছু শিখবেন?” – পড়ে দেখতে পারেন। 

পোর্টফোলিও ওয়েবসাইটে যদি আপনি ব্লগ সেকশন যুক্ত করেন, এবং তাতে যদি আপনি নিয়মিত লেখালেখি করেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা! এর জন্য যে আপনাকে পারফেক্ট আর্টিকেল রাইটার হতে হবে তা কিন্তু নয়! বেসিক কিছু জিনিস জানলেই আপনি এটি পারবেন। 

বলছিলাম ব্লগ সেকশনের কথা। এই সেকশনে আপনি নতুন কী কী শিখছেন, কী কী শেখার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করেছেন সেগুলো স্টেপ বাই স্টেপ তুলে ধরুন। আপনি কীভাবে শিখতে পছন্দ করেন, কোন লার্নিং টেকনিক আপনি ফলো করেন ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরুন। 

মনে করুন আপনি একজন ফ্রন্ট-এন্ড ওয়েব ডেভেলপার। আপনি এখন চাইছেন একজন ফুল স্ট্যাক ওয়েব ডেভেলপার হতে। এর জন্য কোথা থেকে কী শিখছেন, সিলেবাস কীভাবে নির্ধারণ করছেন, কত সময় নিয়ে গোল এচিভ করছেন ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরুন। এতে করে দুটো লাভ হবে। 

নতুন কোনো কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বাকি ১০ জনের থেকে এগিয়ে রাখবে। কারণ হিসেবে এই যে আপনার শেখার আগ্রহ, শেখার পদ্ধতি এই ব্যাপারগুলো নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর কর্মকর্তাদের খুবই আকৃষ্ট করে। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আপনার দক্ষতার চেয়ে আপনার শেখার আগ্রহ যেকোনো ক্ষেত্রে আপনাকে বহুগুণ এগিয়ে রাখবে। 

আরেকটি হচ্ছে একটি ব্যক্তিগত নোটবুক তৈরি হয়ে যাবে। এখানে আপনি নিজের কাজের গতিবিধি ট্র্যাক করতে পারবেন। কোনো বিষয় লিখে রাখলে সেটি ভূলে যাবেন না। অনেক দিন পরও যদি একবার চোখে পরে, তখন মনে হবে “হ্যাঁ আমার ঐ বিষয়ে শেখা উচিৎ” 

নিজের ক্রেডিবিলিটি বৃদ্ধি করুন:

সময়ের পরিক্রমায় আপনি বহু মানুষের সাথে পরিচিত হবেন। নতুন নতুন কমিউনিটির সাথে যুক্ত হবেন। এদের মধ্যে থেকেই কেউ না কেউ আপনাকে উচ্চ আসনে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এর জন্য প্রয়োজন অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু কে আপনাকে সরল মনে বিশ্বাস করবেন? 

এখানে দুজন ব্যক্তির সিনারিও তুলে ধরছি, আপনি এই দু’জনের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন?

প্রথম ব্যক্তিঃ যিনি মৌখিকভাবে আপনার সামনে উপাস্থপন করেছেন, “আমি একজন ওয়েব ডেভেলপার। আমি দেশি-বিদেশি অনেক ক্লায়েন্ট এর ওয়েব সাইট তৈরি করে দিয়েছি”।  

দ্বিতীয় ব্যক্তিঃ যিনি লিখিত আকারে কিংবা তার পোর্টফোলিও সাইট আপনার সামনে তুলে ধরেছেন “আমি এই ৪টি দেশি আইটি ফার্ম এর ওয়েব সাইট তৈরি করেছি, এই ৩টি ওয়েব সাইটের বাগ ফিক্স করেছি, এই ৫ জন বিদেশি ক্লায়েন্ট এর ৫টি ই-কমার্স ওয়েব সাইট তৈরি করে দিয়েছি, অন পেইজ এসইও বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছি, পাশাপাশি এখন বহুব্রীহি থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং শিখছি ” 

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আপনি দ্বিতীয় ব্যক্তিকেই বিশ্বাস করবেন!

তাই যখন আপনি নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপনার কাজ, সমস্যা সমাধান এর কৌশল ইত্যাদি তুলে ধরবেন, তখন কাউকে যেচে গিয়ে কিছু বলতে হবে না। বরং তারা নিজেরাই আপনার যোগ্যতার সঠিক বিচার করতে পারবেন। 

এমনও হতে পারে আপনার নিয়মিত ব্লগ লেখালেখি দেখে কেউ তার ওয়েব সাইটের ফ্রীলান্স আর্টিকেল রাইটার হিসেবে আপনাকে আহ্বান করলো।

নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে আপনার দক্ষতা ও কাজের মার্কেটিং করুন:

ধরে নিন আপনি একজন ফটোগ্রাফার। আপনি খুব ভালো ছবি তোলেন। গ্রামের মনোরম দৃশ্য অসাধারণভাবে তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু আপনার সেই ছবি গুলো ঐ ক্যামেরাবন্দি হয়েই রয়েছে। প্রচারের অভাবে তেমন প্রসারও হলো না। 

কিন্তু আপনি জানেন কি? আমাদের দেশীয় বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফার দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছবি প্রদর্শনী করছে! ন্যাশনাল জিওগ্রাফির নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন সবাই? এই ন্যাশনাল জিওগ্রাফির যে মাসিক ম্যাগাজিন বের হয়, সেই ম্যাগাজিনে আমাদেরই দেশিয় ফটোগ্রাফার কে.এম আসাদ – এর ছবি কভার ফটোতে স্থান করে নেয়।

তথ্যসূত্র: 1.  Friday Magazine

     2. Hifipublic

K.M Asad এর নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট থেকে নেয়া ছবি
Photo by: K.M Asad

হয়তো আপনিও তাদের মতো ভালো ছবি তুলতে পারেন। তবে ছবিগুলোকে শুধুমাত্র ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে নিজের পরিচিত সার্কেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে, প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে আপনাকে অনেক বেগ পেতে হবে। যারা এই প্রফেশনে উচ্চ আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তারা তাদের সেরা কাজগুলো শোকেজ (Showcase) করে রাখেন, ইন্টারনেট এর কল্যানে সেগুলো দেশ – বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সেগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিনে নেন। এভাবে বিশাল অংকের টাকাও আয় হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন একজন ফটোগ্রাফারের একটি পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট কতটা জরুরী!

কিন্তু শুধু যে একজন ফটোগ্রাফারের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। আপনি একজন ওয়েব ডিজাইনার হলে আপনার ডিজাইন করা ডেমো সাইট গুলো তুলে ধরতে পারেন। একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হলে ডিজাইন গুলো সাজিয়ে রাখতে পারেন। এভাবে পেশাভেদে কম বেশি সকলেরই একটি ওয়েব সাইট থাকা জরুরী।

ফ্ল্যাক্সিবিলিটি

অনলাইন রেজুমে বা অনলাইন পোর্টফোলিও এর ফ্ল্যাক্সিবিলিটি অনেক বেশি। আপনি বিশ্বের যে কোনো জায়গায় বসে মাত্র কয়েকটা ক্লিকের মাধ্যমেই নতুন কনটেন্ট যুক্ত করতে পারছেন, পুরনো কনটেন্ট আপডেট করতে পারছেন যা একটি ছাপা কাগজের রেজুমিতে কখনো সম্ভব না। এছাড়া কাগজের রেজুমিতে আপনি আপনার ফিল্ড ওয়ার্ক এর ছবি দিতে পারছেন না, কোনো ভিডিও যুক্ত করতে পারছেন না ইত্যাদি অসংখ্য ড্রব্যাক রয়েছে।

আর অনলাইন পোর্টফোলিও এর ক্ষেত্রে ব্যপারটা একদমই তার উল্টো। বরং আপনি এই ওয়েব সাইটেই একটি সেকশন রাখতে পারেন যেখান থেকে কেউ চাইলে আপনার সিভি / রেজুমি পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফাইল বা pdf ফরম্যাটে ডাউনলোড করতে পারেন!

কীভাবে তৈরি করবেন নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট

সত্যি বলতে বহু রিসোর্স রয়েছে একটি ওয়েব সাইট তৈরি করার জন্য। এর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ডপ্রেস, উইক্স, Weebly ইত্যাদি। চাইলে আপনি HTML, CSS, Bootstrap দিয়েও কোড করে নিজের জন্য একটি সাইট বানাতে পারেন। তবে ফ্ল্যাক্সিবিলিটি, রিলায়াবিলিটি এসব বিষয় চিন্তা করলে সিএমএস বা Content Management System গুলো হবে সবচেয়ে ভালো অপশন। আর CMS এর কথা আসলে এক বাক্যে যেটি বলতে হয় তা হলো WordPress.

শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্য যে, আপনি চাইলে মাত্র ১ ঘন্টায় ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে একটি ওয়েব সাইট তৈরি করে ফেলতে পারবেন যেখানে আপনার এক লাইনও কোড লিখতে হবে না। তাহলে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, ওয়ার্ডপ্রেস কি সস্তা বা নিম্ন মানের? তার উত্তর হচ্ছে “না”। 

২০১৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে যতগুলো ওয়েবসাইট সচল রয়েছে, তার ৩৬ শতাংশই এই ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে করা। বিশ্বের বড় বড় অসংখ্য ওয়েবসাইট এই ওয়ার্ডপ্রেস দিয়েই চলে। একজন নন-টেকনিশিয়ান ব্যাক্তিও খুব সহজে এই সাইট ক্রিয়েট ও মেইন্টেইন করতে পারেন। অসংখ্য ফ্রী এবং পেইড প্লাগিন রয়েছে যেগুলো দিয়ে প্রায় যা চান তাই করতে পারবেন। এরকম অনেক কারনেই WordPress এখনো সেরা সিএমএস।

ফ্রী ওয়ার্ডপ্রেস কোর্স করতে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার করুন

3 thoughts on “নিজের পোর্টফোলিও ওয়েবসাইট থাকা জরুরী কেন?”

Leave a Comment