ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাস্টারসঃ Seveso Disaster

১০ জুলাই, ১৯৭৬ সাল। ঘড়ির কাঁটায় ১২ টা বেজে ৩৭ মিনিট। ইতালির মিলান শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে Lombardy এলাকায় একটি মাঝারি সাইজের রাসায়নিক কারখানায় রিয়্যাক্টর ট্যাংকের সেফটি ভাল্ভ থেকে বিষাক্ত TCDD (2,3,7,8-tetrachlorodibenzo-p-dioxin) গ্যাস নিঃসরণ ঘটে যা হাজার হাজার মানুষের স্বাস্থ্য আর সম্পদহানির কারণ। ইঞ্জিনিয়ারিং সেফটি স্টাডিতে এই ঘটনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কারখানার নাম ICMESA (Industrie Chimiche Meda Società Azionaria) যা ছিল বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি Roche Group এর Subsidiary. তো এই কারখানার “প্ল্যান্ট বি” তে 1,2,4,5-Tetrachlorobenzene(নিচের চিত্রের 1) থেকে কস্টিক সোডার সাহায্যে 2,4,5-Tricholorphenol(চিত্রে 2) তৈরি চলছিল যেখান থেকে TCDD(3) তৈরি করা হয়।

এই বিক্রিয়ার জন্য যে তাপমাত্রা দরকার, সেটার ব্যবস্থা ঐ সময় কারখানায় ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় নিজস্ব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে Exhaust জলীয়বাষ্প সরবরাহ করা হবে। এসময় বাষ্পের তাপমাত্রা ছিল ১৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর চাপ ছিল ১২ bar, যার ফলে রিয়্যাক্টরের বিক্রিয়া মিশ্রণের তাপমাত্রা ১৫৮ ডিগ্রি তে যায়, যা এর স্ফুটনাঙ্কের (১৬০০ সে.) খুব কাছাকাছি। শুরু করা হয় Production. পুরো প্রসেসটা ছিল ব্যাচ প্রসেস মানে একবার Raw ম্যাটেরিয়াল ইনপুট দেয়া হবে, প্রডাকশন চলবে, প্রোডাক্ট একবারে নিয়ে নেয়া হবে, তারপর আবার ইনপুট দেয়া হবে। কিন্তু ফাইনাল স্টেপে যাওয়ার আগে প্রসেস চলাকালেই শীতলকারক ইথিলিন গ্লাইকল বের করে নেয়া শুরু হয়। কারণ প্ল্যান্ট বন্ধের প্রস্তুতি চলছিল। এদিকে প্ল্যান্টের অন্যান্য প্রসেসগুলো বন্ধ করা শুরু হয়, কারণ ঐ সময় ছিল সপ্তাহের শেষ আর তৎকালীন ইতালিয়ান আইন অনুসারে সপ্তাহের শেষে প্ল্যান্ট বন্ধ করার নিয়ম ছিল। এর ফলে বিদ্যুৎ এর চাহিদা কমে যাওয়ায় টারবাইনের গতি কমে আসে। ফলে Exhaust জলীয়বাষ্পের তাপমাত্রা বেড়ে ৩০০ ডিগ্রিতে পৌছায়। এই উত্তপ্ত বাষ্পই রিয়্যাক্টরে দেয়া হচ্ছিল। এর কারণে ট্যাংকের উপরের খালি অংশের দেয়ালও বেশ উত্তপ্ত হয়।


এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, সেই সময় প্ল্যান্ট অপারেটরদের কাছে জলীয় বাষ্পের তাপমাত্রা সংক্রান্ত কোন তথ্য ছিল না, যা তৎকালীন সেফটি আইনের বিশাল সীমাবদ্ধতা। যার কারণে সাধারণভাবে বাষ্প সরবরাহ আর Stirrer বন্ধ করে দিয়ে প্রোডাকশন শেষ করার কাজ শুরু করেন তারা। এদিকে একে তো অতিরিক্ত তাপ তাতে আবার Stirrer বন্ধ, যার ফলে অল্প যায়গায় বেশি তাপ আটকে যায়। এর কারণে ঐ সব যায়গায় তাপমাত্রা ১৮০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায় এবং এর ফলে তাপোৎপাদী সাইড রিয়াকশন শুরু হয়। ৭ ঘণ্টা পর রিয়্যাক্টরের তাপমাত্রা ২৩০ ডিগ্রি এ পৌঁছায়, যার কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিক্রিয়া চলতে থাকে। এর কারণে সেফটি ভাল্ভ খুলে যায়, যেটা না হলে বিস্ফোরণ হতো। কিন্তু এর ফলে প্রায় ৬ টন কেমিক্যাল ১৮ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ১ কেজি TCDD ছিল। সাধারণত ১ পি,পি,এম,* হারে TCDD তৈরি হবার কথা, কিন্তু অতিরিক্ত তাপে ১০০ পি,পি,এম, হারে উৎপাদন শুরু হয়। যে কারণে নিঃসরিত গ্যাসে TCDD বেশি ছিল।

আক্রান্ত এলাকাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়ঃ

১. জোন A যেখানের মাটিতে TCDD ঘনমাত্রা ছিল >৫০ microgram per square meter আর লোকসংখ্যা ৭৩৬ জন।

২. জোন B যেখানের মাটিতে TCDD ঘনমাত্রা ছিল ৫ থেকে ৫০ microgram per square meter আর লোকসংখ্যা ৪৭০০ জন।

৩. জোন C যেখানের মাটিতে TCDD ঘনমাত্রা ছিল ৫ microgram per square meter এর কম আর লোকসংখ্যা ৩১৮০০ জন।

Seveso এর নামে নামকরণ করার কারণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ছিল এই কমিউনিটি। এছাড়াও আশেপাশের Meda, Desio, Cesano Maderno কমিউনিটি গুলোও কমবেশি আক্রান্ত হয়। মোট প্রায় ৪০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়। প্রায় সাড়ে তিন হাজার পোলট্রি আর খরগোশ মারা যায়। জোন A থেকে সব মানুষ সরিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে দেয়া হয়। ১৫ জন শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় স্কিন ইনফেকশনের কারণে। অনেক মানুষ Chloracne নামক চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। ১৬৬০ জনকে পরীক্ষা করে ৪৪৭ জনেরই এই রোগ পাওয়া গিয়েছিল। ভয়াবহ ব্যাপার এই যে, দুর্ঘটনার ২০ বছর পরও বিষাক্ত কেমিক্যালের প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। ক্যান্সার থেকে শুরু করে প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়া সহ নানান সমস্যা দেখা দেয়।

ICMESA এর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর Herwig von Zwehl এবং ডিরেক্টর অফ প্রোডাকশন Paolo Paoletti কে গ্রেফতার করা হয়। প্রায় ৪৭.৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার বরাদ্দ দেয়া হয় পুরো কারখানা এলাকা দূষণমক্ত করার জন্য। এই ঘটনার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন Seveso Directive নামে নতুন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেফটি আইন তৈরি করে যা বর্তমানে এর রেভাইজড এডিশন Seveso II Directive নামে চালু আছে।

শেয়ার করুন

Leave a Comment