পথচলার প্রেরণা

একটা গল্প বলি,

একবার এক প্লেন দুর্ঘটনায় একটি মাত্র লোক ছাড়া সবার মৃত্যু হয়। প্লেনটি ক্র্যাশ করে একটা দ্বীপে, নির্জনদ্বীপে। জনমানবহীন দ্বীপের চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। কিন্তু তাকে উদ্ধার করার মতো কোন জাহাজও আশেপাশে চোখে পড়ছিল না। দিনযায়, মাস যায়- লোকটি আশায় আশায় থাকে যে, কোনও জাহাজ হয়ত তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। কিন্তু আশায় আশায় শুধু দিন কেটে যায় তবু আশা পূরন হয়না। এদিকে একাকি দ্বীপে থাকার জন্য লোকটি ইতিমধ্যে একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর তৈরি করে ফেলল আর সে ঘরের মধ্যে থেকেই সারাদিন শুধু সমুদ্রের পানে তাকিয়ে থাকে আর ভাবতে থাকে এই বুঝি কেও উদ্ধার করতে এলো। অবশেষে লোকটি শুধুদীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সৃষ্টিকর্তা-তুমি দেখো”।

তো এর কদিন পরের ঘটনা। আজও লোকটি আগের মতোই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিন্তু বেলা যতো গড়াতে লাগলো লোকটির ততোই ক্ষুধা পেতে লাগলো। যা ফলমূল ছিল সবশেষ হয়ে গেছে! অগত্যা, লোকটি খাবার জোগাড় করতে কুটির ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এবং বেশ কিছুক্ষণ পর যখন আবার খাবার নিয়ে কুটিরে ফিরে আসে, দেখতে পায় তার উনুনের জ্বালানো আগুন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তার ছোট্ট কুটিরে আগুন ধরে গেছে এবং আগুন প্রায় সম্পূর্ণ কুটিরটাকেইপুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলেছে! লোকটি আর সহ্য করতে পারেনা। সে প্রচণ্ডরাগে-ক্ষোভে আর দুঃখে চিৎকার করে বলে ফেলে, “হে ঈশ্বর! তুমি আমার থেকে আমার পরিবারকে দূরে সরিয়ে এই নির্জনে এনে ফেলেছো, এখন আবার আমার সামান্য কুটিরটাকেও তুমি জ্বালিয়ে দিলে; এমনকাজ তুমি কিভাবে করতে পারলে!!” কথাগুলো বলেই লোকটি কান্নায় ভেঙেপড়ে, এমনসময় দ্বীপের ধারে একটি ছোট জাহাজ এসে নোঙর ফেলে আর তার থেকে কিছু লোক বেরিয়ে এসে হারানো লোকটির কাছে এসে সাহায্য চায় কিনা জানতে চায়। লোকটি তখন কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, তারা তাকে কিভাবে খুঁজে পেল। জবাবে তখন জাহাজের লোকগুলো বলে, “আমরা দূর থেকে এইদ্বীপে আগুন আর ধুঁয়া দেখে বুঝে নিই কেও হয়তো সাহায্য চাইছে তাই এখানে এসেছি”। কথা গুলো শুনে লোকটি সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ পেয়ে বিস্মিত হয়ে যায়।সে বুঝতে পারে, “সত্যিই আজকে তার ঘরে আগুন না লাগলে এইদ্বীপ থেকে হয়তো কোনোদিনও সে ছাড়া পেতোনা!!”

সৃষ্টিকর্তা মানুষের ভালোর জন্যই সবকিছু করেন কিন্তু মানুষ আমরাই ভুল করে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহকে অস্বীকার করি; দেখতে চাই না আসলে তিনি আমাদের জন্য কি রেখেছেন। ফলে অসন্তুষ্ট হয়ে গালমন্দ করতে থাকি নিজেদের ভাগ্যকে। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহের অপেক্ষায় থাকতে হবে, নিশ্চিত আমাদের সামনে হয়ত এমন কিছু অপেক্ষা করছে যা আমাদের জীবনটাকেই বদলে দেবে! একটু গুলতির কিংবা তীর এর দিকে খেয়াল করে দেখা যেতে পারে। তীর নিক্ষেপের জন্য এটিকে যত পিছনে টেনে আনব আমি তীর টি ঠিক ততটাই দূরে আঘাত হানতে সক্ষম হবে, অর্থাৎ এটি তত দূরের লক্ষ্যমাত্রায় আঘাত হানতে সক্ষম হবে। ঠিক স্বাভাবিক অবস্থান থেকে পতন যত গভীরে, স্বাভাবিক অবস্থান থেকে উত্থানও কমপক্ষে তত উচুতে। প্রকৃতি আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক।

“কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে”, তা আমরা কে না জানি! তাই বড় অর্জনের জন্য একটু বড় বড় ঢেউ আমাদেরকে সহ্য করতেই হবে। আর সেজন্যই আমাদের জন্য বিধাতার এই বার্তা, সতর্কতাস্বরূপ। তবে “পতন” কে আমি কিভাবে মূল্যায়ন করব আর কি সিদ্ধান্ত নিব সেটির মাধ্যমেই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।

একবার, ৮০ বছর বয়স্কা এক বৃদ্ধা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। প্রথম দিন ক্লাসে আসলে বৃদ্ধ বয়সে তার এমন পড়াশুনার প্রতি ঝোঁক দেখে সবাই তার কাছে জানতে চাইলো যে, এই বয়সে কেন তিনি এমনটা করলেন। বৃদ্ধা হাসিমাখা মুখে জানালেন, “আসলে আমার নামে কোনও একাডেমিক ডিগ্রী নেই। তাই আমার খুব ইচ্ছা একটা ডিগ্রী অর্জন করা আর তাই এ স্বপ্ন পূরন করতেই আমি ভার্সিটি ভর্তি হয়েছি”।

ক্লাসে সবাই বৃদ্ধাকে একজন অভিভাবক কিন্তু সুন্দর বন্ধু হিসেবে গ্রহন করে নিলো। বৃদ্ধা যেখানেই যেতেন সেখানেই তাঁকে সবাই তার জন্য শ্রদ্ধার সাথে আসন ছেড়ে দিত। সুযোগ পেলেই সবাই তার কাছে তার জীবন সম্পর্কে জানতে চাইতো। কিভাবে তিনি তার দীর্ঘ জীবন পার করেছেন, কিভাবে সকল বাঁধাকে উপেক্ষা করে আজ এতদূর আসতে পেরেছেন- এসব ব্যাপারে তার কাছে সবাই জিজ্ঞাসা করতো। দেখতে দেখতে ৪ টি বছর কেটে যায়। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার পর একদিন কলেজে অতীতের সকল ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এক আনন্দসভা ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। আনন্দসভায় সেই বৃদ্ধাকে একটি ভাষণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। সকলের অনুরোধে বৃদ্ধা ভাষণ দিতে স্টেজে উঠতে গেলে হঠাৎপা পিছলে পড়ে যান। বৃদ্ধার এমন অবস্থা দেখে সবাই কিছুটা বিব্রত বোধ করলেও বৃদ্ধা কারও দিকে না তাকিয়ে হাসিমুখেই ভাষণ দিতে শুরু করেন এবং শুরুতেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে উঠলেন, “পড়ে গিয়েছিলাম বলেই এখানে উঠতে পেরেছি। যখন উঠতে চেষ্টা করেছি তখন আমার ধারনা হয়েছে এতো উঁচু জায়গার উপর আমি উঠতে পারবো না। ঠিক তাই হয়েছে- চেষ্টা করা মাত্র পড়ে গিয়েছি। আর যখনই পড়ে গিয়েছি তখনই মাথাই চিন্তা এসেছে আমি উঠেই ছাড়বো আর তাই উঠতে পেরেছি। তার মানে এখানে আমার জন্য পড়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তা না হলে উপরে ওঠার মতো মানসিকতার সৃষ্টি হতো না”।


“সুউচ্চ পর্বতে আরোহন করতে গেলে অবশ্যই প্রথম পদক্ষেপটা একেবারে নিচের দিকেই থাকে।“–উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
সম্ভবতঃ এটি কাউকে আরো বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখার, সাহস করার এবং উদ্যোমী হওয়ার স্পৃহা যোগায়, তাই এই পিছিয়ে পড়া। আর এটাই সত্য। মাঝে মাঝে পিছিয়ে পড়াকে পিছিয়ে পড়াও বলেনা।যেমনটি “তীর” এর নিক্ষেপন থেকেই আমরা সেটি দেখতে পাই।
অনেককে দেখা যায় যে, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক ফলাফল খারাপ করে জীবনের সব “বৃথা” বলে আখ্যায়িত করতে। কেউ পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে পারছে না, কেউ পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারল না, তার থেকেই জন্ম নেয় রাজ্যের অনাস্থা, বিশেষত নিজের উপর। বিশ্বের ২৩তম ধনী, জ্যাক মা, হার্ভার্ড-এ ১০ বার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কে এফ সি যখন চায়নায় আসে, তখন ২২/২৩(এক্সাক্টি সংখ্যাটি মনে নেই) জন চাকরীর আবেদনকারীর মধ্যে সে-ই একমাত্র আবেদনকারী, যাকে নেওয়া হয়নি। পুলিশের চাকরির ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে তার জন্য। এবং এরকম অনেক রেকর্ড আছে মানুষের জীবনের। তো, জ্যাক মা যদি ওখানেই থেমে যেত যে, সে এতবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে হার্ভার্ড থেকে, কে এফ সি’র একমাত্র প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে, তাহলে আজকে আর তার আলিবাবা’র মতো বিশাল সম্রাজ্য গড়া হতো না। এমনকি যদি সে, ওসব ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাতও না হত, তবে সংশয় আছে হার্ভার্ড এর শিক্ষা দিয়ে অথবা কে এফ সি’র চাকরি দিয়ে আদৌ এরকম সম্রাজ্য গড়তে পারত কিনা। তাই, যেকোন ব্যর্থতা থেকে আমাদের উন্নতর কিছু প্রতিক্ষা করাটিই যথাযথ কাজ হবে।


বুয়েট এ পড়া, কারো জীবনের লক্ষ্য হতে পারেনা, এটি কেবলি লক্ষ্যে পৌছানোর একটি ধাপ মাত্র। তেমনি ভাবে, অন্যকোন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আইনস্টাইন এর একটি কথা মনে পড়ছে,

“The one who follows the crowd will usually get no further than the crowd, The one who walks alone, is likely to find himself in places no one has ever been.”
Einstein

একেবারে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগের অভাব? তাহলে খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, এম আই টি, ইয়েল এর কয়জন শিক্ষক ওসব ভার্সিটি কিংবা ইন্সটিটিউট থেকে অনার্স করেছে? যে সংখ্যাটি আছে সেটি এই অভাববোধ করাকে যৌক্তিক দেখাচ্ছে না! দেখা যাবে ঐসব শিক্ষকদের অনেকে এমন ভার্সিটিথেকে অনার্স করেছে যেগুলো বিশ্বের টপ ২০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই! যদি আমি কাছের কোন উদাহরন দেই, তবে চলে আসবে একজন প্রফেসরের কথা যাকে আমি চিনি, তিনি গওহর রিজভী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন, কিন্তু হার্ভার্ড সহ নামকরা অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতা করছেন। এছাড়া বহু মানুষ অনেক কম খ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেও বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছেন। অসংখ্য পাওয়া যাবে।


এখন আমি বলতে পারি, আমার মেধা নেই। যেটির কারনে আমি নিজেকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখতে কিংবা তা বাস্তবায়ন করতে ভয় পাচ্ছি, সাহস পাচ্ছিনা। তবে তাই যদি হয়, মনেপড়ে নিউটনের একটি কথা,

“If I am anything, which I highly doubt, I have made myself so by hard work” Newton

অতএব আমার মেধা না থাকার অভিযোগ মুহুর্তের মধ্যেই আসলে ধুলোই মিশে গেল, মানে এটি গ্রহনযোগ্য না। পরিশ্রম করে সব অতিক্রম করা যায়। লেগে থাকা দরকার। এটি অন্যতম একটি পন্থা, সাফল্যের দিকে। আর হাল ছেড়ে দেয়াটা, স্বপ্নহারিয়ে যেতে দেয়াটি হচ্ছে জীবনযুদ্ধে পরাজিত হওয়া কিংবা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করার ন্যায়।

শেয়ার করুন

Leave a Comment