কীভাবে যে কোনো কিছু শিখবেন?

শেখা ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত একটি প্রক্রিয়া। সবার শেখার পদ্ধতি একরকম নয়। আপনার শেখার পদ্ধতি আর আপনার আরেকজন বন্ধুও ঠিক একইরকম শেখার পদ্ধতি অনুসরণ করবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার ছোটবেলার একটা অভ্যাসের গল্প দিয়ে শুরু করি। আমি সবসময়ই অংক করার সময় গান শুনতাম। গান আমাকে বাকি সবকিছু থেকে আলাদা করে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে অংক করতে সাহায্য করতো। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে এটা নাও হতে পারে।

এমনকি আমি নিজেই অংক ছাড়া অন্য কোনো কিছু, যেমনঃ বাংলা, বিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞান পড়ার সময় গান কিংবা কোনোরকম শব্দই সহ্য করতে পারতাম না! তাই ‘শেখার পদ্ধতি’  ব্যাপারটাকে একটা নির্দিষ্ট নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে ফেলা বেশ কঠিন। তবে কিছু গবেষণালব্ধ পদ্ধতি অবশ্যই আছে, যেগুলো ব্যবহার করে আমরা আমাদের শেখার পদ্ধতিকে আরো কার্যকর ও আনন্দদায়ক করে তুলতে পারি। আজ আমরা এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। 

কয়েকটি প্রশ্নের আলোকে আমরা আমাদের পুরো আলোচনাটি সাজাবো। এই প্রশ্নগুলোই আমাদের কাঙ্ক্ষিত উত্তরের কাছে পৌঁছে দিবে।

এবারে একে একে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া যাক।

কীভাবে দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখবো?

মাঝেমাঝেই এমন কিছু সময় আসে, যখন খুব সহজ সহজ বিষয়গুলোও মাথায় ঢোকে না। আবার কখনো কখনো অনেক চেষ্টা করেও আমরা নতুন কিছু শিখতে পারি না। এমন সময়ে আপনি কী করেন? 

আমাদের মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে কিছু জানাশোনা থাকলে আমরা এ ধরনের সমস্যা থেকে বেশ সহজেই উতরে যেতে পারি। গবেষকদের মতে, আমরা মূলত দুইভাবে চিন্তা করি, যাদেরকে আমরা ফোকাসড থিংকিং এবং ডিফিউজড থিংকিং- এই দুইভাগে ভাগ করতে পারি।

ফোকাসড থিংকিং মোডের সাথে আমরা খুবই পরিচিত। আমরা যখন কোনোকিছু বোঝা বা পড়ার জন্য আমাদের সম্পুর্ণ মনোযোগ দিই, সেটাকে বলা হয় ফোকাসড মোড। অন্যদিকে, ডিফিউজড মোড সম্পর্কে আমাদের ধারণা বেশ কম। এই ধারণাটি আমাদের মস্তিষ্কের বিরতি অবস্থার সাথে সম্পর্কিত। আমরা যখন কোনোকিছু নিয়ে গভীরভাবে মগ্ন থাকার পরে বিরতিতে যাই, আমাদের অবচেতনে তখনও ঐ বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা চলতেই থাকে। এটাই ডিফিউজড থিংকিং। এই মোডে আমরা যে কোনো বিষয়কে একটা ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন পারসপেকটিভে চিন্তা করতে পারি। 

তবে নিউরোসায়েন্টিস্টদের মতে, আমরা একইসাথে এই দুই অবস্থায় থাকতে পারি না, হয় ফোকাসড অথবা ডিফিউজড মোড- যে কোনো এক অবস্থায় আমরা থাকতে পারি। এটা অনেকটা কয়েন দিয়ে টস করার মতো ব্যাপার – যে কোনো একপাশ উপরে থাকবে। 

প্রবলেম সল্ভিং এর জন্য ফোকাসড মোড এবং ডিফিউজড মোড উভয়ের ব্যবহার আমরা অনেক বিখ্যাত সৃজনশীল মানুষের মধ্যেই দেখতে পাই। যার অন্যতম একজন উদাহরণ হচ্ছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি। দালি তার সাররিয়াল পেইন্টিং নিয়ে কাজ করার সময় অদ্ভুত একটি পদ্ধতি অনুসরণ করতেন।

দালি প্রায়শই একটা আরাম-চেয়ারে বসে চিন্তা করতেন। চেয়ারে বসে থাকার সময় তিনি সবসময় হাতে একটা চাবির গোছা রাখতেন। চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেই তার হাত থেকে চাবি পড়ে যেতো আর চাবির শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যেতো। দালি মূলত ফোকাসড এবং ডিফিউজড মোডের চমৎকার সমন্বয় করতেন এভাবে। ঘুমের মধ্যকার ডিফিউজড মোডের চিন্তাগুলোকে ফোকাসড মোডে নিয়ে আসতেন চাবির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার মাধ্যমে। 

অনেকেই মনে করতে পারেন এই পদ্ধতিটা হয়তো আর্টিস্টদের ক্ষেত্রে কার্যকর; বিজ্ঞান, গণিত বা অন্যান্য হার্ড সায়েন্সের ক্ষেত্রে তা অকার্যকর। একেবারেই ভুল! পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী থমাস আলভা এডিসনও একইরকম পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। তিনি শুধু দালির মত চাবির বদলে বল-বিয়ারিং হাতে নিয়ে আরাম-চেয়ারে বসতেন।

সালভাদর দালি
সালভাদর দালি

মোদ্দা কথা হচ্ছে, যখন আপনি নতুন কিছু শিখছেন, বিশেষ করে যখন আপনি কঠিন কিছু শিখছেন, তখন মস্তিষ্কের এই দুই চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে বারবার ঘুরপাক খেতে হয়। তখনই আপনি কার্যকরভাবে কোনোকিছু শিখতে পারবেন। 

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজন সবসময় বলতেন, তিনি নিজে থেকে কোনো কিছু আবিষ্কার করেন না। তার ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে নামিগিরি দেবী এসে তাকে সব বলে দিয়ে যান। পৃথিবীশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হওয়া সত্ত্বেও রামানুজন বেশ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন।

সে কারণেই হয়তো তিনি এসব উদ্ভুতুড়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কীভাবে রামানুজন কঠিন কঠিন গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতেন- সেই রহস্য আপনারা এতক্ষণে সমাধান করে ফেলেছেন। কি? তাই না?

তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুই পদ্ধতি ব্যবহার করার জন্য আমাদের কী কী করতে হবে? প্রশ্নটা খুব কঠিন হলেও উত্তরটা আসলে খুবই সহজ। আমাদের মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য যে কাজগুলো করতে হবে তা হলো পর্যাপ্ত ঘুম, মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাবার ও ব্যায়াম। এর সাথে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিরতি নেওয়া, নিজেকে পুরস্কৃত করা, পড়ার জন্য নিরিবিলি ও শান্ত পরিবেশ তৈরি করা এবং ফোনসহ যাবতীয় ডিসট্রাকশন থেকে দূরে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চলুন এগুলো নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক। 

শ্রীনিবাস রামানুজন
শ্রীনিবাস রামানুজন

১. পর্যাপ্ত ঘুম

আমাদের মস্তিষ্ককে কার্যকরী রাখতে প্রতিদিন ৭-৯ ঘন্টার আরামদায়ক ঘুম প্রয়োজন। সঠিক শেখার পদ্ধতি অনুযায়ী তথ্য মনে রাখার জন্য ঘুম খুবই কার্যকরী। ভালো ঘুমের পূর্বশর্ত হিসেবে কিছু অভ্যাস তৈরি করা যেতে পারে: 

  • ঘুমের অন্তত আধা ঘন্টা আগে থেকে যাবতীয় ধরনের স্ক্রিন থেকে দূরে থাকতে হবে। একেবারেই সম্ভব না হলে ডিভাইসে Reading Mode চালু করে রাখতে হবে, যেন ব্লু লাইট থেকে আমাদের চোখ দূরে থাকে। 
  • একটি আরামদায়ক বেডটাইম রুটিন তৈরি করতে হবে। যার অংশ হতে পারে ঘুমানোর আগে বই পড়া, গান শোনা কিংবা কুসুম গরম পানিতে গোসল করা, মেডিটেশন ইত্যাদি। 
  •  আপনার বেডরুম যেন শান্ত ও আরামদায়ক হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যাবতীয় আলোর উৎস বন্ধ করতে হবে। অবশ্য ঘুমের জন্য সহায়ক হালকা আলোর বাতি জ্বালিয়ে রাখা যেতে পারে। 
  • ঘুমের অন্তত ৫-৬ ঘন্টা আগে থেকে ক্যাফেইন জাতীয় কিছু গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

২. মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাবার

পুষ্টিকর ও শক্তিপ্রদায়ক খাবার খেলে আমাদের মস্তিস্ক সতর্ক থাকে এবং এই অবস্থায় যে মস্তিস্ক খুব দ্রুত তথ্য প্রসেস করতে পারে। দিনের শুরুতেই ভালো নাশতা খাওয়া খুবই কার্যকর। নাশতায় সিদ্ধ ডিম এবং সতেজ ফল খাওয়া খুবই ভালো অভ্যাস। পড়ার সময় প্রচুর পানি পান করতে হবে। শরীর ডিহাইড্রেটেড থাকলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

৩. ব্যায়াম

নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীর সুস্থ থাকে, মন ভালো থাকে। খুব ক্লিশে শোনাচ্ছে, না? আসলে এই ব্যাপারটা এতোই বহুল চর্চিত যে আলাদা করে আলোচনা করার কিছু নেই। একটু ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করলেই অজস্র কন্টেন্ট পাওয়া যাবে এ বিষয়ে।

৪. পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিরতি নেওয়া

একটানা দীর্ঘসময় আমাদের মস্তিস্ক কর্মক্ষম থাকে না। মস্তিস্কেরও বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। আপনার নির্ধারিত পড়ার সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য খুব চমৎকার একটি শেখার পদ্ধতি হচ্ছে পোমোডোরো টেকনিক। প্রোকাস্টিনেশন দূর করা এবং প্রোডাক্টিভ থাকার জন্য এটি অত্যন্ত কার্যকর একটি পদ্ধতি। ১৯৯০ সালের দিকে ফ্রান্সেসকো সিরিলো এই শেখার পদ্ধতিটি জনপ্রিয় করে তোলেন।

পোমোডোরো টেকনিক
পোমোডোরো টেকনিক। ছবিঃ lifehack.org

যেহেতু আমাদের মস্তিষ্কের ‘attention span’ খুব বেশী নয়, তাই মনোযোগ দিতে হয় এরকম যে কোনো কাজ আমরা ছোটো ছোটো সময়ে ভাগ করে নিতে পারি। আমাদের মস্তিষ্কের একটানা সর্বোচ্চ মনোযোগ ধরে রাখার সেই সময়টি হচ্ছে ২৫ মিনিট।  তাই আমরা পড়ার সময় ২৫ মিনিট একটানা পড়বো। তারপর ৫ মিনিট বিরতি নেবো। তারপর আবার শুরু করবো। অর্থাৎ – 

২৫ মিনিট পড়া + ৫ মিনিট বিরতি = এক পোমোডোরো 

এভাবে আমরা কত পোমোডোরো সময় পড়বো তা শুরুতেই ঠিক করে নিতে পারি। 

এখন আপনাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে কেন এটাকে ‘পোমোডোরো’ বলা হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়িত্ব আপনাদের উপরেই থাকলো। উত্তর খোঁজার জন্য আপনাকে সময় দেওয়া হলো এক পোমোডোরো! 

৫. নিজেকে পুরস্কৃত করা

একটানা পড়তে থাকলে আমাদের মস্তিস্ক সমানভাবে কর্মক্ষম থাকে না তা আমরা জানলাম। কিন্ত আমরা পোমোডোরো টেকনিক অনুসরণ করতে থাকলেও পরপর কতবার এটা করতেই থাকবো? এক সময় তো বিরক্তি চলেই আসবে, তাই না? আর প্রোকাস্টিনেশন তো আছেই সাথে।

এই সমস্যা দূর করার একটা ভালো পদ্ধতি হতে পারে নিজেকে পুরস্কৃত করা। আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে – তিন পোমোডোরো পড়ার পরে আপনি আধা ঘন্টা PUBG খেলবেন। বা চার পোমোডোরো শেষে ফেলুদা ফেরতের একটা এপিসোড দেখবেন। খেয়াল করে দেখুন, আমরা কিন্ত প্রোকাস্টিনেশন করার সময় এরকম ভিডিও গেম খেলা বা সিরিজ দেখার মত পছন্দের কাজগুলোই করে থাকি।

কিন্ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা একদিকে যেমন নিজেকে পুরস্কৃত করবো, অন্যদিকে নিজের দুর্বলতাগুলোকে শক্তিতে রুপান্তর করাও শিখে ফেলবো! দারুণ না? 

৬. নিরিবিলি ও শান্ত পড়ার পরিবেশ

আপনি পড়তে বসেছেন।  এমন অবস্থায় আপনার ছোট ভাই পাশের রুমে ফুল ভলিউমে কার্টুন দেখা শুরু করেছে। আপনার পড়ার টেবিল খুবই অগোছালো হয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ খুঁজেও ক্যালকুলেটরটা পাচ্ছেন না। ঘরটা বেশ নোংরা হয়ে আছে। ঘরে একটা ছোটো বাল্ব লাগানো, একেবারেই পর্যাপ্ত আলো নেই। এমন অবস্থায় নিশ্চয়ই ভালোভাবে পড়াশোনা করা সম্ভব না।

পড়ার জন্য একটা নিরিবিলি শান্ত পরিবেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাসায় থাকলে আপনার পড়ার রুটিনের ব্যাপারে সবাইকে জানিয়ে রাখুন যেন ঐ সময়ে অতিরিক্ত শব্দের ব্যাপারে সবাই সচেতন থাকে। একান্তই সম্ভব না হলে কোনো নিরিবিলি লাইব্রেরিতে পড়তে পারেন। পড়ার জায়গাটি আরামদায়ক ও পরিষ্কার হলে দ্রুত মনোযোগ আসে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, বসার জায়গা যেন এতো আরামদায়ক না হয়ে যায় যে আপনি ঘুমিয়ে পড়েন!

৭. ফোন এবং অন্যান্য ডিসট্রাকশন থেকে দূরে থাকা

আপনি পড়ছেন। এমন সময়ে একটু দূরে রাখা ফোনে নোটিফিকেশন লাইট জ্বলে উঠলো। হয়তো আপনার একটু মেসেঞ্জার চেক করতে ইচ্ছা হচ্ছে। হয়তো নোটিফিকেশন লাইটটা দেখেই আপনার মনে হচ্ছে কোনো দরকারি ইমেইল আসলো কি না। এ ধরনের ডিসট্রাকশন আমাদের পড়ার গতি মন্থর করে দেয়। তাই পড়ার সময় ফোনটা সুইচ অফ করে রাখতে পারেন। অন্তত দৃষ্টিসীমার বাইরে তো রাখতে হবেই। আর অবশ্যই সাইলেন্ট করে রাখতে হবে। এই কাজে আপনাকে সাহায্য করার জন্য Forest, Breakfree বা Flipd এর মতো বেশ কিছু প্রোডাক্টিভিটি অ্যাপ রয়েছে, যেগুলোও আপনি কাজে লাগাতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং: বর্তমান দশকের প্রস্তুতি

কীভাবে পড়া মনে রাখবো?

১. পুরো বিষয়কে ছোটো ছোটো খন্ডে ভাগ করা

অনেক বড় কোনো বিষয় একবারে পড়তে গেলে আমাদের কাছে শুরুতে ব্যাপারটা অনেক কঠিন লাগতে পারে।  তাই শুরুতেই আমরা স্পিড রিডিং এর মাধ্যমে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা পেতে পারি। এই সময়ে আমাদের কাছে যে বিষয়গুলো কঠিন মনে হয়েছে তার একটা তালিকা করে ফেলা যেতে পারে। এর মাধ্যমে পুরো বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার হবে। যে টপিকগুলো কঠিন মনে হয়েছে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত পড়াশোনা করে পুরো বিষয়টি ‘Closed Reading’ এর মাধ্যমে আমরা আত্মস্থ করতে পারি। 

যেমন: ধরুন আপনি সালোকসংশ্লেষণ নিয়ে পড়ছেন। শুরুতেই স্পিড রিডিং এর সময় কিছু বিষয় আপনি টুকে রেখেছেন যেগুলো সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই- ফটোফসফোরাইলেশন, ফটোলাইসিস, ফোটন, আত্তীকরণ, জারণ-বিজারণ ইত্যাদি। এবারে আপনি প্রথমেই এই বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করে ফেলুন – হতে পারে কোনো বই পড়ে কিংবা ভিডিও দেখে। এরপর বিস্তারিতভাবে পুরোটা টপিক পড়ে ফেলুন। দেখবেন বেশ সহজ মনে হবে তখন।

২. নোট নেওয়া

‘The Curve of Forgetting’ বলে একটি ধারণা রয়েছে। জার্মান দার্শনিক হারমান এবিংঘাউসের এই ধারণা থেকে আমরা জানতে পারি, যে কোন কিছু সম্পর্কে জানার ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমরা ঐ বিষয়ের ৪০% তথ্য ভুলে যাই। যদি আমরা রিভিউ না করি, তাহলে পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় আমরা ৬০% ভুলে যায়। তাই যে কোন পড়াই দীর্ঘ সময় মনে রাখতে হলে তা পুনরায় পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এর জন্য সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে খুব ভালোভাবে নোট নেওয়া। 

আমরা অনেকেই আজকাল হাতে নোট না নিয়ে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে নোট নিয়ে থাকি। নোট নেওয়ার পদ্ধতি প্রত্যেকেরই ভিন্ন হলেও কিছু বহুল পরিচিত পদ্ধতি আমরা অনুসরণ করতে পারি। যেমন:

কর্ণেল মেথড

কাগজ বা খাতার পাতাকে তিনটি ভাগে ভাগ করুন। বামপাশে দুই ইঞ্চি (Cue Column), ডান পাশে ছয় ইঞ্চি (Notetaking area) ও নিচে ২ ইঞ্চি জায়গা (Summary)  রাখুন। Notetaking area তে আপনার মূল নোট লিখুন।

Cue Column এ গুরুত্বপুর্ণ কিওয়ার্ড ও টারমিনোলজি লিখুন। নিচে Summary অংশে পরবর্তীতে রিভিউ করার জন্য সারমর্ম বা কোনো প্রশ্ন লিখতে পারেন।

সুবিধা: এটি খুবই গোছানো পদ্ধতি। পরবর্তীতে রিভিউ করার জন্য বেশ কার্যকরী। গুরুত্বপূর্ণ টারমিনোলজি খুব সহজেই চোখে পড়ে। 

অসুবিধা: মূল নোট নেওয়ার জন্য জায়গার পরিমাণ কিছুটা কম। 

কর্ণেল মেথড
ছবিসূত্র: pdf.wondershare.com

আউটলাইনিং মেথড

এটি নোট নেওয়ার সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। লেকচার শুনতে শুনতে এর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ইনডেন্ট করে করে লিখে রাখতে হয়। পরবর্তীতে কিছু যোগ করার জন্য লেখার মাঝে জায়গা ফাঁকা রাখা বেশ কার্যকরী।

আউটলাইনিং মেথড
ছবিসূত্র: https://www.easybib.com

সুবিধা: মূল পয়েন্টগুলো বেশ সহজেই চোখে পড়ে। লিখিত অংশ থেকে কী কী প্রশ্ন আসতে পারে তা সহজেই বোঝা যায়। 

অসুবিধা: নতুন তথ্য লেখার ফাঁকা জায়গা রাখার জন্য চিন্তা করতে হয়। লেকচারার খুব দ্রুত কথা বলতে থাকলে নোট নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

ম্যাপিং মেথড

রহস্য-রোমাঞ্চ গল্পে গোয়েন্দা বা পুলিশেরা যেভাবে মাইন্ডম্যাপিং করে, এই পদ্ধতিটি ঠিক সেরকমই। একটি ধারণা থেকে আর কী কী ধারণার উৎপত্তি হয়েছে তা গ্রাফিক রিপ্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে লিখতে থাকতে হবে।

সুবিধা: এক ধারণার সাথে আরেক ধারণার সম্পর্ক নিমিষেই চোখে পড়ে। লেকচারের পুরো বিষয়টি চোখের সামনে থাকে। চিন্তার খোরাক যোগায়। ক্রিটিকাল থিংকিং এর সুযোগ তৈরি করে। 

অসুবিধা: লেকচার বড় হলে এক পাতায় পুরোটা নোট নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো বিষয় বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন হলে জায়গার স্বল্পতা তৈরি হয়।

ম্যাপিং মেথড
ছবিসূত্র: learninghub.ac.nz

চার্টিং মেথড

চার্টিং মেথড
ছবিসূত্র: msliewsclass.weebly.com

লেকচারে ধারাবাহিক কোনো ঘটনা বা প্রক্রিয়া বর্ণ্না করা হলে আমরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি। কলাম এবং সারিতে ভাগ করে পরপর লিখে যেতে হয়।

সুবিধা: ঘটনা বা প্রক্রিয়ার ক্রম সহজেই বোঝা যায়। একাধিক ধারণার মধ্যে পার্থক্য বা সম্পর্ক করা যায় সহজেই। 

অসুবিধা: লেকচার সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকা লাগে। সকল ধরনের লেকচারে এই পদ্ধতি কার্যকর নয়।

সেন্টেন্স মেথড

এটা বোঝা সবচেয়ে সহজ। নতুন ধারণা, চিন্তা বা যে কোনো কিছু পরপর নাম্বারিং করে লিখতে হয়।

সুবিধা: সকল ধরনের তথ্য লেখা সম্ভব হয়। 

অসুবিধা: গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো আলাদা করা কষ্টকর। পরবর্তীতে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে পুরোটা নতুন করে লিখতে হয়।

সেন্টেন্স মেথড
ছবিসূত্র: www.utc.edu

৩. পড়ার সারমর্ম তৈরি করা

যে কোন বিষয়ে আমরা কতটুকু জানি কিংবা যা বুঝেছি তা আসলেই কতটুকু বুঝেছি – এ ব্যাপারটি যাচাই করার অত্যন্ত কার্যকরী একটি পদ্ধতি হচ্ছে ঐ বিষয়ের একটি সারমর্ম তৈরি করা। কোনো নতুন কিছু শেখার সময়, হতে পারে সেটা কোনো ক্লাস লেকচার বা কোনো বই থেকে পড়া কিছু – সে সম্পর্কে কয়েকটা প্যারাগ্রাফ বা কিছু বুলেট পয়েন্টের মাধ্যমে আমরা পুরো বিষয়টির একটি সারমর্ম করে ফেলতে পারি।

সবসময় যে তা লিখেই করতে হবে – ব্যাপারটা এমন না। হতেই পারে মৌখিকভাবে আপনি আপনার শিক্ষক বা কোনো বন্ধুকে বিষয়টি সংক্ষিপ্ত আকারে বুঝিয়ে বললেন। আবার হতে পারে গুরুত্বপুর্ণ টপিকগুলো নিয়ে আপনি কিছু ফ্ল্যাশকার্ড তৈরি করলেন। মাধ্যম সেটাই হোক না কেন, সারমর্ম করার সময় পুরো বিষয়টি নিয়ে আপনি পুনরায় চিন্তা করবেন।

হয়তো কোথাও আটকে গেলে সে সম্পর্কে আরেকটু ঘাঁটাঘাঁটি করবেন। এর মাধ্যমে মগজের ব্যায়াম হবে – ফেলুদার ভাষায় মগজাস্ত্রে ধার দেওয়া হবে। ফলে আপনি যা পড়েছেন তা সম্পর্কে আপনার গভীর ধারণা তৈরি হবে।

আরও পড়ুনঃ IQ নাকি EQ? কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

কীভাবে নিজের জন্য আদর্শ শেখার পদ্ধতি খুঁজে বের করবো?

আমরা ইতোমধ্যেই বুঝতে পারছি, হরেক রকম শেখার পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্য থেকে আমাদের নিজের জন্য আদর্শ শেখার পদ্ধতি খুঁজে বের করতে হবে। সেটা খুঁজে বের করতে  এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে-

১. কতটুকু বুঝেছি তা যাচাই করা

আমি আসলে কতটুকু জানি আর কতটুকু জানি না – তা যাচাই করা খুবই প্রয়োজনীয়। এ বিষয়টিকে বইয়ের ভাষায় বলা হয় Metacognition. যে বিষয়টি আপনি পড়ছেন বা যে বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করছেন সে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে আপনাকে দু’টি প্রশ্ন করতে হবে নিজেকে – 

  • এই বিষয়ে আমি কী জানি?
  • এই বিষয়ে আমি কী জানিনা বা কোন অংশটা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি? 

যখনই আপনি বুঝতে পারবেন যে কোন অংশটি সম্পর্কে আপনার ধারণা এখনো অস্পষ্ট, তখন আপনি সে অংশের উপর আরো মনোযোগ দিতে পারবেন। 

কোনো বিষয়ে নিজের জ্ঞানকে যাচাই করার খুব ভালো একটি পদ্ধতি হলো কুইজ। যদি আপনি এমন কোনো বই পড়ে শিখেন যেখানে সেলফ-এসেসমেন্ট করার জন্য প্রশ্ন রয়েছে (ছোটোবেলার পাঠ্যবইয়ের প্রতি অধ্যায়ের শেষের প্রশ্নের মত) বা যদি কোনো টিউটোরিয়াল দেখে শিখেন যেখানে সেলফ-এসেসমেন্ট কুইজ রয়েছে – তাহলে এগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে।

একই সাথে আমরা পূর্বে সারমর্ম করার যে পদ্ধতিটি নিয়ে আলোচনা করেছি, সেভাবে পুরো বিষয়ের সারমর্ম তৈরির মাধ্যমেও নিজের জ্ঞানকে যাচাই করে নিতে পারেন। 

২. নিজের শেখার পদ্ধতি এর SWOT এনালাইসিস

SWOT অর্থ Strength, Weakness, Opportunities এবং Threats। SWOT এনালাইসিস মূলত ব্যবসার ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত একটি ধারণা। তবে আমরা আমাদের শেখার পদ্ধতি এর ক্ষেত্রেও এই ধারণার ব্যবহার করতে পারি। আমরা যে পদ্ধতিতে পড়ি তার শক্তি, দুর্বল দিক, সুযোগ এবং সমস্যাগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার মাধ্যমে আমাদের শেখার পদ্ধতিকে আরো কার্যকরী করে তুলতে পারি।

যেমন: আপনি যদি রাত জেগে পড়তে অভ্যস্ত হন তাহলে এর শক্তিশালী দিক কী? হতে পারে, রাতের বেলা আপনার বাসা দিনের অন্যান্য সময়ের চেয়ে নিরিবিলি থাকে, তাই আপনার পড়তে সুবিধা হয়। দুর্বলতা হতে পারে, আপনি যেহেতু ভীষণ রিয়াল মাদ্রিদ ফ্যান এবং বাংলাদেশ সময়ে রাতেই খেলাগুলা হয়, তাই প্রায়শই রাতে আপনি না পড়ে ফুটবল দেখতে বসে যান।

সুযোগ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে, আপনি যেহেতু ডে শিফটে পড়েন, তাই রাতে আপনার পক্ষে সবচেয়ে নির্বিঘ্নে পড়া সম্ভব। এক্ষেত্রে থ্রেট হলো, নিয়মিত রাত জাগা শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর। এখন এসব চিন্তা করে আপনার কাছে বিকল্প রয়েছে ভোরবেলা উঠে পড়তে বসা। আপনি এক্ষেত্রেও আবার SWOT এনালাইসিস করে দু’টো ক্ষেত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে কোনটা আপনার জন্য পড়ার সর্বোৎকৃষ্ট সময়, তা বের করে ফেলতে পারবেন। 

কীভাবে নিজের পড়া ধারণাগুলো নিয়ে ক্রিটিকাল থিংকিং করবো?

কোনো কিছু পড়ে গভীরভাবে অনুধাবন করা ও বিভিন্ন ধারণার মধ্যে সমন্বয় ও পার্থক্য করতে পারা, বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ – এসব কিছুই হচ্ছে ক্রিটিকাল থিংকিং। ক্রিটিকাল থিংকিং করতে হলে-

১. যা শিখছি সে বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করা

শুধুমাত্র তথ্য মনে রাখার মধ্যেই আপনার পড়াশোনা সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। যা পড়ছেন তা পুরোপুরি বুঝতে হলে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে। এই প্রশ্নগুলো এবং তার উত্তর খোঁজার প্রক্রিয়া আপনাকে পুরো বিষয়টিকে যথাযথভাবে বুঝতে সাহায্য করবে। 

ধরুন আপনি কোনো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যেমন: পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা করছেন। পলাশীর যুদ্ধের সমগ্র ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রেক্ষাপট, ফলাফল বুঝতে আপনি নিজেকে কিছু প্রশ্ন করতে পারেন – 

  • কেন এই যুদ্ধ ঘটলো? 
  • আমরা কীভাবে জেনেছি যে এই ঘটনাগুলো ঘটেছে অর্থাৎ তথ্যের উৎস কী ছিল? 
  • যদি পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় না ঘটতো তাহলে উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ কেমন হতো? 

এমন বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে আপনি পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে ও অনুধাবন করতে পারবেন। 

আবার ধরুন আপনি এমন একটি বিষয় নিয়ে পড়ছেন যা আগে কখনো পড়েননি। হতে পারে,  আপনার গ্রামের জমিজমা বিক্রির জন্য ভূমি আইন সম্পর্কে পড়ছেন। শুরুতেই আপনি এই বিষয়ে ২৫টি প্রশ্ন নির্ধারণ করুন যা আপনি ভূমি আইন সম্পর্কে জানতে চান। এই প্রশ্নগুলোই আপনাকে গভীরভাবে বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে।

২. বিভিন্ন ধরনের ধারণার মধ্যে সমন্বয় করা

আমরা যখন কোনো বিষয়ে পড়ি, তখন বিভিন্ন টপিকগুলোকে বিচ্ছিন্ন তথ্য হিসেবে চিন্তা না করে এক টপিকের সাথে আরেক টপিকের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করতে পারি। একটা bird’s eye view থেকে দেখলে টুকরো টুকরো তথ্যগুলোর সমন্বয়ে একটা সামগ্রিক ধারণার উৎপত্তি হবে, যা আমাদেরকে পুরো বিষয়টি গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।

এই তথ্যগুলোকে আমরা নিজের অভিজ্ঞতার সাথেও সমন্বিত করতে পারি। যেমন: ধরুন আপনি গেম থিওরি এবং প্রিজনার’স ডিলেমা নিয়ে পড়াশোনা করছেন। প্রিজনার’স ডিলেমা পড়তে পড়তে আপনি গতকাল রাত আটটার সংবাদে দেখা জলবায়ু পরিবর্তনের রাজনীতির কোনো মিল খুঁজে পেলেও পেতে পারেন। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব পৃথিবীর সকল দেশকেই ভোগাবে। তবুও বেশিরভাগ দেশ নিজের অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা চিন্তা করে কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

(গেম থিওরি দিয়ে এই ব্যাপারটি খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার একটু চেষ্টা করবেন নাকি? )এই ব্যাপারটির মত আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার আরো অনেককিছুই গেম থিওরি দিয়ে ব্যাখা করা যায়। এভাবে আমরা চাইলে নতুন একটা ধারণাকে ভিন্ন আঙ্গিকে নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে অনেক চমৎকার চমৎকার বিষয় অনুধাবন করতে পারি।  

৩. তথ্যের উৎস যাচাই করা

একজন ক্রিটিকাল থিংকার কখনোই যা দেখছে, শুনছে বা পড়ছে তা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করবে না। তাই আপনি যখন কিছু পড়ছেন, অবশ্যই খেয়াল রাখবেন তথ্যটি কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে, সূত্রটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তথ্যটি পুরানো কী নতুন ইত্যাদি। আপনি আরো যেসব প্রশ্ন করতে পারেন: 

  • লেখক নিজের যুক্তিগুলো প্রমাণ করতে কী কী সাক্ষ্য দিয়েছেন 
  • যে ব্যাক্তি তথ্যটি দিচ্ছেন তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কতটুকু 
  • যেই তথ্য বা ব্যাখ্যাটি দেওয়া হয়েছে এর কোনো বিকল্প তথ্য বা ব্যাখ্যা আছে কি না এবং থাকলে কোনটা অধিক যুক্তিযুক্ত

৪. মূল কনসেপ্ট খুঁজে বের করা

আপনি একটি লেকচার শুনছেন, বই পড়ছেন বা হয়তো ইন্টারনেটে ছোট্টো একটি আর্টিকেল পড়ছেন – পড়ার বিষয় যায় হোক না কেন, তার মূল কনসেপ্ট খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে সবসময়। ধরুন আপনি বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ছেন। পড়তে পড়তে আপনি দেখলেন বারবার বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিষয়টি উঠে আসছে। ইতিহাসের যেই অংশ বা ঘটনাই আপনি পড়ছেন না কেন, তার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করুন আসলেই অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার ধারণাটি সত্য কি না।

কীভাবে রুটিনমাফিক পড়াশোনা করবো?

আমাদের আশেপাশে অনেকেই আছে যারা খুব চমৎকারভাবে রুটিনমাফিক পড়াশোনা করতে পারে। আবার আমরা অনেকেই হয়তো এ ব্যাপারে বেশ কাঁচা। তবে খুশির সংবাদ হচ্ছে এটা কোনো জাদু মন্ত্র না। আমরা সবাই একটু একটু করে ব্যাপারটা শিখে ফেলতে পারি। যেমন:

১. অভ্যাস তৈরির কৌশল

আমাদের জীবন মূলত আমাদের অভ্যাসের যোগফল। আপনি সুস্থ নাকি অসুস্থ – সেটা আপনার অভ্যাসের ফলাফল। আপনি সফল নাকি অসফল – সেটাও আপনার অভ্যাসের ফলাফল। আপনি যে কাজগুলা বারবার করেন, সেই কাজগুলোই আপনার ব্যক্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে। 

এখন কেউ যদি তার কোনো অভ্যাস পরিবর্তন করতে চাই, তাহলে তাকে কী করতে হবে? 

সবচেয়ে প্রথমে তাকে বুঝতে হবে কীভাবে অভ্যাস তৈরি হয়। অভ্যাস তৈরির পুরো প্রসেসকে আমরা চারটি ভাগে ভাগ করতে পারি: Cue, Craving, Response, Reward. এই প্রত্যেকটি অংশ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারবো কীভাবে অভ্যাস তৈরি হয়, কীভাবে অভ্যাস কাজ করে এবং কীভাবে আমরা অভ্যাসের ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারি। প্রতিটি অভ্যাসের পেছনেই এই প্যাটার্নটি কাজ করে এবং আমাদের মস্তিস্ক সবসময়ই  এই প্যাটার্ন অনুসরণ করে। 

প্রথম ধাপ হচ্ছে Cue। Cue আমাদের মস্তিস্ককে যে কোনো আচরণের জন্য ট্রিগার করে। এটা এক ধরনের তথ্য যা আমাদেরকে কোনো Reward এর প্রতি প্রলুব্ধ করে। আদিম সমাজে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন সব Cue এর প্রতি মনোযোগ দিতেন যা তাদের খাবার, পানি, বাসস্থানের  প্রাথমিক চাহিদা পূরণের সম্ভাবনা তৈরি করে। আধুনিক সমাজে এমন পুরস্কার হচ্ছে অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা, প্রশংসা, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি।

আমাদের মস্তিস্ক সবসময় আমাদের আশপাশের পরিবেশকে বিশ্লেষণ করে পুরস্কারের সম্ভাবনা খুঁজতে থাকে। যেহেতু Cue হচ্ছে সেই প্রাথমিক ধাপ যা আমাদের পুরস্কারের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে, তাই এটি আমাদের মধ্যে Craving তৈরি করে। 

Craving আমাদের যাবতীয় অভ্যাস তৈরিতে অনুপ্রেরণামূলক শক্তি (Motivational Force) হিসেবে কাজ করে। এই Craving তৈরি না হলে আমরা কোনো কাজ করার জন্য নিজেদেরকে কোনো ‘কারণ’ দিতে পারি না। সত্যি বলতে, আমরা কখনো কোনো অভ্যাস তৈরি বা পরিবর্তন করতে চাই না। বরং সেই নতুন অভ্যাস আমাদের অবস্থার যেই পরিবর্তন করে, আমরা সেই পরিবর্তনকে চাই।

যেমন: যারা ধূমপান করে, তারা আসলে সিগারেট খেতে চায় না, বরং সিগারেট খাওয়ার পর তারা যে প্রশান্তি অনুভব করে (অবশ্য এ প্রশান্তি খুবই সাময়িক এবং এবং ভবিষ্যতে এর প্রচুর ক্ষতিকর ফলাফল রয়েছে), তারা সেই প্রশান্তি চায়। কিংবা আপনি আসলে টেলিভিশন চালু করতে চান না, বরং টেলিভিশন চালু করলে আপনি যেই বিনোদন পাবেন, আপনি সেই বিনোদনের আনন্দ চান। 

Craving ব্যাপারটা প্রত্যেক মানুষের জন্যই আলাদা। একজন যে Cue থেকে Craving অনুভব করবে, আরেকজনের ক্ষেত্রে তা ঘটবেই এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। Cue ততক্ষণ পর্যন্ত অর্থহীন যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এটাকে Craving এ রূপান্তর না করবো। প্রতিটি Cravingই আপনার অবস্থা পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। একজন মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও আবেগ কোনো Cueকে Craving এ রূপান্তর করে।

তিন নম্বর ধাপ হচ্ছে Response। এটা হচ্ছে সেই আসল ধাপ যেখানে আমরা অভ্যাস তৈরির জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কাজ করি। Craving থেকে Response ঘটবে কী ঘটবে না তা নির্ভর করে কাজটি করতে আপনি কতটুকু অনুপ্রাণিত এবং কাজটি করার জন্য কী পরিমাণ বাধা আপনাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে তার উপরে। যদি কোনো কাজ করতে আপনার অনুমানের চেয়েও বেশী শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করতে হয়, খুব সম্ভবত আপনি তা করতে পারবেন না।

Response ধাপটি আপনার সক্ষমতার উপরেও নির্ভর করে। কথাটা শুনতে খুব ক্লিশে শোনালেও সত্যি, আপনি সেটাই করতে পারবেন যা আপনার সক্ষমতার ভেতরে। আপনি যদি বাস্কেটবল খেলতে চান কিন্ত আপনার উচ্চতা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম হয়, তাহলে ব্যাপারটা আসলেই বেশ কঠিন। 

সবশেষে Response ধাপটিতে ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারলে আপনি একটি Reward বা পুরস্কার পাবেন। এটাই আপনার অভ্যাসের ‘End Goal’। এভাবে, Cue থেকে Craving তৈরি হয়, Craving থেকে আমরা সেই অনুযায়ী response করার জন্য অনুপ্রাণিত হই, response তখন cue এর আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।  ঠিক এভাবে cue, craving, response, reward; cue, craving, respond, reward… এই চক্র চলতে চলতে আমাদের কোনো অভ্যাস তৈরি হয় বা পরিবর্তিত হয়। 

The habit loop
ছবিসূত্র: jamesclear.com/habit-triggers

এই চারটি ধাপের ধারণা ব্যবহার করে একটি প্র্যাকটিকাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে আমরা কোনো ভালো অভ্যাস তৈরি করতে পারি বা খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারি।

এই ফ্রেমওয়ার্ককে আমরা নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেকার ‘Atomic Habits’ এর লেখক জেমস ক্লিয়ারের ভাষায় ‘Four Laws of Behaviour Change’ বলে উল্লেখ করতে পারি। এই প্রত্যেকটা সূত্রকে আমরা লিভারের সাথে তুলনা করতে পারি। যদি আমরা এই লিভারগুলোকে ঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারি, তখন খুব সহজেই ভালো অভ্যাস তৈরি করা সম্ভব।

একইভাবে উল্টোটাও সত্যি কিন্ত!

কীভাবে ভালো অভ্যাস তৈরি করবেন:

১ম সূত্র – Cue: কাঙ্ক্ষিত কাজকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। 

২য় সূত্র – Craving: কাজটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।

৩য় সূত্র – Response: কাজটা সহজভাবে করার চেষ্টা করতে হবে।

৪র্থ সূত্র – Reward: কাজটির মধ্যে সন্তুষ্টি খুজতে হবে

উল্টোভাবে, খারাপ অভ্যাস বাদ দিতে হলে:

১ম সূত্র – Cue: কাজ/ঘটনাটি যতটা সম্ভব অদৃশ্য করে তুলতে হবে।

২য় সূত্র – Craving: কাজটিকে খুবই অনাকর্ষনীয় করে তুলতে হবে।

৩য় সূত্র – Response: কাজটি কঠিন করে তুলতে হবে।

৪র্থ সূত্র – Reward: এই অভ্যাসের জন্য আপনি কতটা অসন্তুষ্ট তা বারবার নিজেকে বোঝাতে হবে।

আরও পড়ুনঃ গ্রোথ মাইন্ডসেটঃ আপনার ব্রেইনকে কীভাবে পরিবর্তন করবেন?

২. পরিমাপযোগ্য ছোট ছোট মাইলফলক তৈরি করা

দীর্ঘমেয়াদি একটি কাজ। তাই আপনি যেই ফলাফল চান তাকে ছোটো ছোটো মাইলফলকে ভাগ করতে হবে। এবং এই প্রত্যেকটা মাইলফলক অর্জন শেষে সেই অর্জনকে উপভোগ করতে হবে, নিজেকে পুরস্কৃত করতে হবে। ধরুন আপনার নিউ ইয়ার রেজোল্যুশন হচ্ছে আপনি সুন্দরভাবে বিতর্ক করা শিখতে চান। এটা বেশ দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া। আপনি পুরো প্রক্রিয়াটা ছোটো ছোটো এমন মাইলফলকে ভাগ করতে পারেন: 

  • বিতর্কের বিভিন্ন ফরম্যাটের নিয়মকানুন জানা 
  • সুন্দর উচ্চারণে কথা বলতে শেখা
  • বাচনভঙ্গির উন্নয়ন 
  • অর্থনীতি, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করা 
  • ভালো বিতার্কিকদের বিতর্ক বিশ্লেষণ করা 
  • এই বছরে অন্তত ৩টি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা 

এই প্রত্যেকটি মাইলফলক অর্জন শেষে আপনি নিজেকে অবশ্যই পুরস্কৃত করবেন। সেই পুরস্কার হতে পারে ছোটো ছোটো ইচ্ছাপূরণ থেকে যে কোনো কিছু। 

৩. Google Calendar ও Google Task এর ব্যবহার

সঠিক শেখার পদ্ধতি অনুসরন না করলে নতুন কিছু শেখা একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনি যদি উচ্চশিক্ষার জন্য GRE বা IELTS দিতে চান, সেই প্রস্তুতি নিতে নিতে আপনি নিশ্চয়ই আপনার চাকরি ছেড়ে দিতে পারবেন না। কিংবা বাসার কাজগুলো অবহেলা করতে পারবেন না। এসবকিছুর মধ্যেই আপনার পড়াশোনা আপনাকে চালিয়ে যেতে হবে। তাই আপনার সময় বিভাজন জরুরি। একটা রুটিনমাফিক পড়াশোনা করা জরুরি।

এই রুটিন তৈরির কাজে, আপনার যাবতীয় কাজগুলোকে সময়ের সাথে বন্টনের কাজে আপনি Google Calendar বা Google Task এর সাহায্য নিতে পারেন। এছাড়াও আরো অনেক সফটওয়্যার বা অ্যাপ আছে যেগুলোও আপনি ব্যবহার করতে পারেন। যেমন: ToDoist, Evernote, Ticktick, Planner Pro, Sectograph ইত্যাদি। 

এই আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম, এখানে যে সকল শেখার পদ্ধতি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো তার সবকিছুই যে আপনার জন্য খাটবে তা সত্যি নয়। মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হচ্ছে আমাদের বৈচিত্র। আর সবকিছুর মত শেখার পদ্ধতির ক্ষেত্রেও তা সত্যি।

আমরা এখানে যা কিছু বলেছি, তার মধ্যে যা যা আপনাদের কাজে লাগবে, আর সাথে নতুন যা কিছু আপনারা আবিষ্কার করবেন – সেসবকিছু নিয়ে একটা জম্পেশ আড্ডার শুরুটা আমি করে দিলাম। এখন আপনাদের অপেক্ষায়! 

হ্যাপি লার্নিং!  

ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স অনলাইন কোর্স!

২০২০ এর দশকে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দশটি দক্ষতার একটি হলো ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। বহুব্রীহির সংক্ষিপ্ত এই অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দক্ষতাগুলো সম্পর্কে জানুন, ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সেগুলো প্রয়োগ করতে চেষ্টা করুন এবং নিজের ও আশেপাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করুন!


এখানে ক্লিক করুন

ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স

শেয়ার করুন

2 thoughts on “কীভাবে যে কোনো কিছু শিখবেন?”

  1. One of the best article I ever read about personal growth. I learned so much. Now its time to implement. Thank you so much bohubrihi.

    Reply

Leave a Comment