You are currently viewing কৈশোরের গল্পের বই

কৈশোরের গল্পের বই

স্কুল কলেজের বাংলা পাঠ্যবইয়ে “বই পড়া” আর “সাহিত্যে খেলা” প্রবন্ধ দুটি তে প্রমথ চৌধুরী বই পড়ার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। সেখানে তিনি একটিতে বলেছেন, ‘লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চেয়ে কম নয়’; আরেকটিতে বলেছেন, ‘France was saved by her IDLERS’। এই ২টি প্রবন্ধ পড়ে বই পড়তে খুব যে উজ্জীবিত হয়েছি তাই কি? অন্যদিকে আবার সৈয়দ মুজতবার আলী বলেছেন “বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না!” আমি বলবো বই পড়ার ইচ্ছাটাই প্রধান, বই কিনে বই পড়তে হবে তা না। আমি জীবনে বই কিনেছি ৫-৬টা, পড়েছি হাজারটা (শ খানেক হবে আসলে :p)। ছোটবেলায় গল্পের বইয়ের প্রতি অসম্ভব টানের কারণে প্রথমে কেনা হয় আলী বাবা ও চল্লিশ চোর। এরপরে বড় ভাই থেকে তিন গোয়েন্দার বই পড়তে শুরু করি। ও পড়তো লুকিয়ে লুকিয়ে আমি পড়তাম ওর থেকে লুকিয়ে।

তিন গোয়ান্দার বই এক সম্পূর্ণ অন্য পৃথিবী তৈরি করতো, কিশোর-মুসা-রবিন যেকোনো একজনের সাথে নিজের মিল খুঁজে বের করতাম। স্যাল্ভিজ ইয়ার্ড এর প্রতিটা কোণা, প্রতিটা গুপ্ত দরজা, রোলস রয়েস, জিনার বাড়িতে যাওয়া, তার দ্বীপে অভিযান প্রতিটা জিনিস অন্য রকম শিহরিত করতো। অনেকের মনে হতে পারে ছেলেমানুষি কাহিনী সব, কিন্তু তিন গোয়েন্দা বিভিন্ন এডভেঞ্চার গুলোতে যে সব তথ্য দেওয়া আছে সব ই সত্য। অনেক দেশ, অনেক প্রাণি, জাতি, উপজাতি নিয়ে মজাদার সব তথ্য দেওয়া আছে। ভীষণ অরণ্য ১,২ পড়ে আমাজানের এবং এর জন্তু জানোয়ারের অনেক কথা জানবেন। যেমন অথৈ সাগর ১,২ পড়ে জানবেন কিভাবে পোকা মাকড় খেয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের নির্জন দ্বীপে বাঁচতে হয়। উঠতি বয়সের ছেলেদের কাছে তিন গোয়েন্দা যেমন মজায় মজায় জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়, তেমনি কিশোরের মত ক্ষুরধার চিন্তাভাবনা, রবিনের মতো কোনো বিষয়ের গভীরে গিয়ে রিসার্চ করা কিংবা মুসার মতো সাহসিকতা দেখানো এসব চরিত্রের প্রতিফলন ঘটবেই।

কৈশোরের গল্পের বই
স্কুল কলেজে অল্প বিস্তর গল্পের বই পড়ার অভ্যাস থাকলে বলে দেয়া যায় এই সবগুলো বই আপনার পরিচিত! [ছবিঃ বহুব্রীহি ব্লগ]

এবার আসি জাফর ইকবাল স্যারের কথায়। উনার সাথে পরিচয় মেকু কাহিনী আর রাজু ও আগুনালীর ভূত দিয়ে। উনার কিশোর উপন্যাস গুলাতে উনি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেছেন, সেসব কথা বাদ ই দিলাম। উনাকে বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখা ও জনপ্রিয়করণের পথিকৃৎ হিসাবে গণ্য করা হয়। উনার আগে কেউ লিখছে বলে জানা নেই যতদূর জানি। কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, পৃ, ফোবিয়ানের যাত্রী, প্রজেক্ট নেবুলা, ত্রাতুলের জগৎ, রুহান রুহান, প্রডিজি(আমার কেনা :P)। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ঠিক কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে এরও যে কালো দিক আছে তা এসব সায়েন্স ফিকশন পড়েই জেনেছি। এসব বই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে যেমন পরিচয় ঘটায় তেমনি এসব নিয়ে আরো জানতে আগ্রহও সৃষ্টি করে।

এখন তার ভাইয়ের কথায় আসি। বাস্তববাদী লেখক হুমায়ুন আহমেদ, তার লেখায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এইসব দিনরাত্রি, আসমানীরা তিন বোন, শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে ইত্যাদি তারই উদাহরণ। গল্পের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ফুটিয়ে তুলেছেন “জোছনা ও জননীর গল্প” ও “দেয়াল” এই দুটি উপন্যাসে। তার অনবদ্য দুটি চরিত্র হিমু আর মিসির আলী। চারিত্রিক দিক দিয়ে মিসির আলী চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি হিমুর পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ ‘হিমু’ চলে প্রতিযুক্তির (anti-logic) তাড়নায়; আর বয়োজ্যেষ্ঠ ‘মিসির আলী’ অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি (pure logic)। এই যুক্তিই মিসির আলীকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করে।

তার কালজয়ী চরিত্রগুলো সাহিত্যের পাতা থেকে মানুষের মস্তিষ্কে ঘুরে ফেরে, ঘুরে বেড়ায় এ-শহরে থেকে ও-শহরে। কখনোবা চলতি পথে বাস্তব জীবনেও দেখা মেলে এই চরিত্রদের। তার লেখায় এক অদ্ভুত সম্মোহনী ক্ষমতা আছে । তাই তো তার সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্রগুলোর জন্যও তীব্র আন্দোলন করে রাজপথে নামে মানুষ (বাকের ভাই)।

এতক্ষণ গেলো দেশি লেখক এর গল্প; বিদেশি লেখক বললে যে বইটির নাম প্রথমে আসে তা হল “হ্যারি পটার”। হ্যা আপনি বলতে পারেন এটার ত মুভিই আছে বই পড়ে কি হবে কিন্তু আমি বলবো যে মুভি দেখার আগে বইগুলা পড়েছে সে খুব লাকি যেমনটি আমি। কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে পারেন হ্যারি পটার সিরিজ এর বই পড়ে, আপনার মন,চিন্তা ভাবনা সব কিছু ছাপিয়ে উঠবে। হ্যারি পটারের মোটা মোটা বইও পড়তাম পাঠ্যবইয়ের ভিতরে লুকিয়ে রেখে। এই সিরিজের শেষ বইটা পড়ে প্রচণ্ড এক ধরনের বিষাদ অনুভব করি।

কৈশোরের গল্পের বই
হ্যারি পটার সিরিজের একটি বইয়ের প্রচ্ছদ

বিদেশি অনেক রাইটার এর অনুবাদ বই পড়া হয়েছে। চার্লস ডিকেন্স এর ‘ডেভিড কপারফিল্ড’, একজন কয়েদী ফ্রেঞ্চ ডাক্তার এর কাহিনী এবং ফ্রেঞ্চ রেভুলেশন নিয়ে গল্প ‘এ টেল অফ টু সিটিজ’, ড্যানিয়াল ডিফোর ‘রবিন্সন ক্রুসো’ একলা নির্জন দ্বীপে ২৮ বছর কাটানোর কাহিনী, রবার্ট লুইস এর ‘দ্যা ব্ল্যাক এরো’, টম সয়্যার এর ‘হাকেল বারি ফিন’, কৃষ্ণাংগদের স্ল্যাভারি নিয়ে বিচার স্ট্যো এর লিখা ‘আংকেল টম’স কেবিন’ যা আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দেয়। এবার আসি পাশের দেশের লেখকদের কথায়। সত্যজিত রায়ের ফেলুদা সিরিজ গোগ্রাসে গিলতাম।কৈলাসে কেলেঙ্কারি, গোসাঁইপুর সরগরম, গ্যাংটকে গণ্ডগোল, ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা এসব বই যেনো সম্পূর্ণ কলকাতা শুদ্ধ সারা ভারত চোখের সামনে এনে দিত। সুনীল এর কাকাবাবু সিরিজ, মনিসংকর এর হোটেল নিয়ে গল্প ‘চৌরঙ্গী’, সমরেশ মজুমদার এর বই সাহিত্য এসব বই আপনার সামনে শুধু বিদেশি সংস্কৃতিই নয়, অনেক ইতিহাসের কথা তুলে ধরবে।

কৈশোরের গল্পের বই

এত সব কথা বললাম যে ছোট বেলা থেকেই আসলে বই পড়ার অভ্যাস করা উচিত। বই না পড়লে একসময় হাঁসফাঁস করতাম। পাঠ্যবইয়ের ভিতর বই রেখে পড়ার কারণে কত বই মা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে,মনে আছে অথৈ সাগর এ মুসা যখন সাগরের নিচে অক্টোপাসের সাথে বাঁচা মরার লড়াই করতেছিল ঠিক তখনি ধরা পড়ি,বই হয় তালাবদ্ধ। ঐদিন যতটা টেনশন ফীল করেছিলাম তা আর বলে বুঝাতে পারব না। আগেই বলেছি হাতে গোনা কয়েকটা বই কিনা হয়েছে। বেশিরভাগ সময় ভাড়া নিয়ে বই পড়তাম,আর বন্ধুদের থেকে নিয়ে নিয়ে।

এখনকার সময়ে বই পড়ার অনেক পথ খুলেছে, ইন্টারনেট, পিডিএফ। যত যাই বলেন মোবাইল, ল্যাপটপ এ আর যাই হোক বই পড়া হয় না,হয় ফেইসবুকিং না হয় সিরিজ দেখা। কিন্তু রক্ত মাংসের বই হাতে নিয়ে পড়বেন, পৃষ্ঠা উলটাবেন, আম্মার ভয় এ বালিশের নিচে,তোষকের নিচে রাখবেন এসব মজা কি পাবেন। যাই হোক ঐ যে বুজুর্গের মতে ‘বই পড়লে মানুষের জ্ঞানের দ্যুতি বাড়ে , আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার সিঁড়ি হচ্ছে বই’। এইসব চিন্তা ভাবনা না,

আমি ভাবি আনন্দের উপলক্ষই হচ্ছে বই। সেই হিসাবে ছোটবেলা থেকেই খুব আনন্দেই দিন কেটেছে আমার।

মোদ্দা কথা বই পড়তে ইচ্ছা লাগে, টাকা না।

Tamzidul Alam
Latest posts by Tamzidul Alam (see all)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments