নিজের আবেগ অনুভুতি বুঝতে পারা ও তা গ্রহণ করে নেয়া ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এর প্রথম ধাপ। কিন্ত এই প্রথম ধাপটিই অনেকের জন্য খুব কঠিন ধাপে পরিণত হয়ে যায় তার পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার কারণে।
ছোটবেলায় কাঁদতে শুরু করলেই যদি বলা হয়, ‘ছেলেরা কাঁদে না’ কিংবা রেগে গেলে যদি বলা হয়, ‘মেয়ে মানুষের এত রাগ ভাল না’ – তাহলে তাদের পক্ষে বড় হয়ে নিজের রাগ, দু:খ এর মত মৌলিক অনুভুতি সনাক্ত করা বা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে, কেননা সে ছোটবেলা থেকে সেসব এড়িয়ে যাওয়া বা চেপে রাখার শিক্ষাই পেয়ে এসেছে।
এখানে আসলে তার পরিবারেরও দোষ নেই, তারাও হয়ত জানতেন না যে নিজের মানসিক সুস্থতার জন্য, অন্যের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য, নিজের অনুভুতি বুঝতে পারা ও তা গ্রহণ করে নেয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আশার বিষয় হল, একটু চেষ্টা করলে ছোটবেলার এ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বৃদ্ধি করা সম্ভব।

এরজন্য প্রথমেই যা জানা প্রয়োজন তা হল, আবেগের ভালো-খারাপ বলে কিছু নেই! আমরা অনেকসময় আনন্দ, ভালোবাসা কে ভালো অনুভুতি , আবার রাগ, দু:খ’কে খারাপ অনুভুতি বলে থাকি, বিষয়টা আসলে এমন নয়।
সব অনুভুতি আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন, সব অনুভুতিই আমাদের কোন না কোন শিক্ষা দেয়। তাই এসব অনুভুতিকে নেতিবাচক অনুভুতি ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। বরং আমাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে, কেন আমি সেটা অনুভব করছি।
যেহেতু আমরা অনেক বছর ধরে এগুলোকে নেতিবাচক অনুভুতি বলে জেনে এসেছি, তাই আমাদের পক্ষে এগুলোকে মেনে নেয়া একটু কঠিন।
যেমন, আপনি অনেক পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিয়ে আশা করলেন যে, এবার আপনিই সর্বোচ্চ নাম্বার পাবেন, কিন্ত ফলাফলের দিন দেখা গেল যে, অন্য কেউ সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছে। এতে আপনার মন খারাপ হতেই পারে, এমনকি হিংসাও লাগতে পারে।
হিংসা আসলে রাগ-দু:খেরই একটা মিশ্র রূপ। কিন্ত এমন অবস্থায় আমরা কিন্ত এটা স্বীকার করতে চাই না যে, আমার মন খারাপ হয়েছে বা হিংসা লাগছে। আমরা ভাবি যে, এগুলো খুব খারাপ অনুভুতি, এসব অনুভব করা মানে আমি ভালো মানুষ না ইত্যাদি ইত্যাদি।
এভাবে প্রকৃত অনুভুতি এড়িয়ে গেলে কিন্ত আপনার পক্ষে কখনোই সেই অনুভুতির পেছনের কারণ বোঝা বা তা নিরসন করা সম্ভব হবে না।
তাহলে এমন অবস্থায় আপনি কি করতে পারেন? আপনি নিজের অনুভুতি সনাক্ত করুন, গ্রহণ করুন, তার পেছনের কারণটা বোঝার চেষ্টা করুন। ধরে নিলাম, কম নাম্বার পাওয়াতেই আপনার খারাপ লাগছে। এর সমাধান কি? পরেরবার বেশি নাম্বার পাওয়া।
কিভাবে তা পাওয়া যায়? এই পরীক্ষায় আপনার প্রস্তুতিতে কোন ঘাটতি ছিল কিনা, উত্তর লেখায় কোন ভুল ছিল কিনা কিংবা উত্তরটা আরও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যেত কিনা তা ভাবার চেষ্টা করুন।
সম্ভব হলে শিক্ষকের সাথে আলাপ করে আপনার কোথায় ভুল হয়েছিল তা বোঝার চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে, যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছে তার সাথে আলাপ করে জানার চেষ্টা করুন সে কিভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে বা উত্তর লিখেছে।
এভাবে নিজের ঘাটতিগুলো পূরণ করে পরেরবার আরো ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিন, আপনার সর্বোচ্চ নাম্বার পাবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে।
কিন্ত আপনি যদি শুরুতেই খারাপ লাগার অনুভুতিটা অস্বীকার করে পুরো বিষয়টা এড়িয়ে যেতেন, তাহলে আপনার নিজেকে আরো দক্ষ করার সুযোগটিও হারাতেন।
তবে, অনুভুতির পেছনের কারণটা সনাক্ত করার সময় এটা খেয়াল রাখতে হবে, যেন সেটা আপনার নিজের কোন আচরণ বা প্রয়োজন হয়, অন্যের কিছু না।
অর্থাৎ, আপনার মন খারাপের কারণ হল আপনি কম নাম্বার পেয়েছেন, আরেকজন কেন বেশি নাম্বার পেল, এটা আপনার বিবেচনার বিষয় না।
কারণ, আমাদের পক্ষে শুধু আমাদের নিজেকেই পরিবর্তন করা সম্ভব। আপনার পক্ষে শুধু আপনার নিজের নাম্বারই বৃদ্ধি করা সম্ভব, অন্যের নাম্বার কমানো সম্ভব না।
সম্ভব হলেও, সে চেষ্টা করা উচিত না! আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নিজের প্রয়োজন পূরণে অবশ্যই সৎ ও বাস্তব পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত।
অর্থাৎ, যেকোন মূল্যে নাম্বার বেশি পাওয়ার জন্য আপনি অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করবেন, এটা উচিত না।
আবার, আপনি এক পরীক্ষায় একশতে চল্লিশ পেলেন, এক সপ্তাহ পরেই সেই বিষয়ে একশতে আশি পাবেন, এ ধরণের লক্ষ্য নির্ধারণও না করাই ভালো।
নিজের সামর্থ্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সব বিবেচনা করে ধাপে ধাপে লক্ষ্য পূরণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
কোনো পরিস্থিতিতে নিজের অনুভুতি ও প্রয়োজন সনাক্ত করার একটি ভালো পদ্ধতি হল, সে ঘটনাটা নিয়ে বিস্তারিত লেখা। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক James Pennebaker চল্লিশ বছর ধরে অনুভূতি লিখে রাখার সাথে তা প্রক্রিয়াকরণের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন।

তার একটি গবেষণা ছিল এমন, ডালাসের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একসাথে একশজন ইঞ্জিনিয়ারকে ছাঁটাই করা হয়, যাদের বয়স ছিল পঞ্চাশের উপর এবং তারা ছাত্রজীবন থেকেই ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।
এই ছাঁটাইয়ে তারা এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে, চার মাসেও তাদের কেউই নতুন চাকরি খুঁজে পায়নি। তখন Pennebaker তাদের নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
তাদেরকে তিন দলে ভাগ করা হয়, যার মধ্যে একদল ছাঁটাইয়ের পুরো প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা, তাদের রাগ, দু:খ, হতাশা নিয়ে লিখবে। আরেকদল এর সাথে কোন সম্পর্কই নেই এমন বিষয় নিয়ে লিখবে, যেমন, সময়ানুবর্তীতা। আরেকদল কিছুই লিখবে না।
লেখা শুরু করার আগে ছাঁটাই নিয়ে মনোভাব বা নতুন চাকরি খোঁজার চেষ্টায় সেই একশজনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না।
কিন্ত লেখা শুরু করার পরেই তাদের মধ্যে চোখে পরার মত পার্থক্য দেখা যায়। গবেষণা শুরু হবার মাসখানেক পরেই যে দল তাদের ছাঁটাইয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছিল, তাদের পুনরায় চাকরি পাবার হার অন্য দুই দলের তুলনায় তিন গুণ বৃদ্ধি পায়।
শুধু তাই না, ছাঁটাইয়ের পর তাদের জীবনে যে হতাশা, নির্জীবতা নেমে এসেছিল, সেটাও তারা কাটিয়ে উঠতে অনেকাংশে সফল হয়।
বিভিন্ন বয়সের, পেশার কয়েক হাজার মানুষের উপর এমন অনেক গবেষণা করা হয়। কেউ তাদের অভিজ্ঞতা কাগজে কলমে লিখেছে, কেউ কম্পিউটারে, কেউ আবার না লিখে একটানা কথা বলে সেটাকে রেকর্ড করেছে। পদ্ধতি যাই হোক না কেন, সবক্ষেত্রে একই ফলাফল পাওয়া গিয়েছে।
এর কারণ কি? কারণ হল, কোন একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গেলে আমরা সেটাকে নানান আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করি, সেখানে আমাদের ভূমিকা, অপর পক্ষের ভূমিকা বোঝার চেষ্টা করি। নিজেদের কোন ভুল-ত্রুটি ছিল কিনা, কোনো ঘটনা অন্য কি পদ্ধতি অবলম্বন করলে আরও ভালোভাবে সামলানো যেত, এসব নিয়ে ভাবি।
এভাবে আমরা এমন অনেককিছু উপলব্ধি করি, যা নিয়ে আগে কখনো ভাবিনি। গবেষণাতেও দেখা গেছে যে, অনেকেই লিখতে লিখতে এমন লিখেছেন- “আমি আজকে বুঝতে পারলাম যে”, “যে কারণে এমন হয়েছে তা হল”, “আমি এখন পুরো বিষয়টা সত্যিকার অর্থে গ্রহণ করতে পেরেছি”।
এসব উপলব্ধি দ্বারা ওই ঘটনাকে আমরা নতুন একটা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শিখি, যা সেই পিছুটান থেকে মুক্ত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আমাদের সাহায্য করে।
James Pennebaker এর মতে, নিজের অনুভুতি নিয়ে লেখার জন্য দিনে মাত্র বিশ মিনিট সময় দেয়াই যথেষ্ট। লেখার সময় বানান, ভাষা, হাতের লেখা বা দাঁড়ি-কমা নিয়েও বেশি চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন নেই।
এই লেখা কেউ পড়বে না, এমনকি আপনি নিজেও হয়ত দ্বিতীয়বার এই লেখা পড়বেন না। শুধু নিজের যা মনে হয়, ভালো খারাপ যাই হোক, তা লিখে যান। আপনার মনই আপনাকে এক্ষেত্রে পথ দেখাবে।
ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স অনলাইন কোর্স!
২০২০ এর দশকে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দশটি দক্ষতার একটি হলো ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স। বহুব্রীহির সংক্ষিপ্ত এই অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট দক্ষতাগুলো সম্পর্কে জানুন, ব্যক্তি ও কর্মজীবনে সেগুলো প্রয়োগ করতে চেষ্টা করুন এবং নিজের ও আশেপাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করুন!

- আপনার অনুভুতিগুলো আপনি কতটুকু বুঝতে পারেন? - December 3, 2020
- গ্রোথ মাইন্ডসেটঃ আপনার ব্রেইনকে কীভাবে পরিবর্তন করবেন? - November 29, 2020
- “তুমি নাকি আমি?” – কমিউনিকেশন ও ইমোশনাল ইনটেলিজেন্স - November 29, 2020
দারুন লিখেছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইজান।